ঘড়ির কাঁটা তখন ৩টা ৩০-এর কাছাকাছি। রাজধানীর বিএএফ শাহীন কলেজের ওভারব্রিজে দাঁড়িয়ে পাঁচ বছরের শিশু আয়াত। বাবার কাছে জানতে চাচ্ছে, ‘বাবা মেয়েরা কখন আসবে? বলো, বলো না।’
সাফ শিরোপাজয়ী সাবিনা-সানজিদারা ঠিক কখন আসবে, তখনও তার সঠিক সময় জানা নেই ব্যবসায়ী মনিরুল ইসলাম টিংকুর। খানিকটা উত্তেজিত হয়ে বাবা উত্তর দিলেন, ‘জানি না। চলো বাসায় চলো।’ তবে শিশু আয়াতের উত্তর, ‘না, আমি চ্যাম্পিয়নদের দেখে বাসায় যাব।’
এমন প্রতীক্ষা শুধু আয়াত ও তার বাবা-মায়ের নয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে ৬০ বছরের বৃদ্ধ সিরাজুল ইসলাম, নাতি-নাতনি নিয়ে অপেক্ষায় গীতা রানি পাণ্ডে। শুধু সাফ শিরোপাজয়ী নারী ফুটবলারদের দেখতেই তাদের এত অপেক্ষা।
অবশেষে বিএএফ শাহীন কলেজ এলাকায় চ্যাম্পিয়নদের ছাদখোলা বাস আসে বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে। তখন হর্ষধ্বনিতে এলাকা প্রকম্পিত করে তোলেন রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ।
গত সোমবার রাতে নেপালকে ৩-১ গোলে হারিয়ে প্রথমবারের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে লাল-সবুজের নতুন গৌরবগাথা রচনা করেন সাবিনা-সানজিদারা। মঙ্গলবার কাঠমান্ডুতে নিজেদের মতো সময় কাটিয়ে বুধবার দেশের মাটিতে পা রাখেন বাঘিনীরা।
ফুটবলার সানজিদার আক্ষেপ ঘোচাতে আয়োজন করা হয় ছাদখোলা বাসের। সে বাসে করেই তাদের বিমানবন্দর থেকে বাফুফে ভবনে নেয়া হয়। তার আগে বিমানবন্দরে দলকে অভ্যর্থনা দেন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল।
এদিকে সকাল থেকেই টিম বাংলাদেশকে বরণ করতে মুখিয়ে ছিল নগরবাসী। বেলা ১১টা থেকে বিমানবন্দর এলাকায় সাধারণ মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভিড় পরিণত হয় জনসমুদ্রে। মানুষের ভিড়ে ভালোবাসায় সিক্ত টিম বাংলাদেশের গাড়ি যেন এগোতেই পারছিল না। ফলে রাজধানীর মোড়ে মোড়ে জনগণের অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হচ্ছিল না।
চ্যাম্পিয়নদের শোভাযাত্রার জন্য বিএএফ শাহীন কলেজের সামনে ওভারব্রিজে মানুষের অপেক্ষা। ছবি: নিউজবাংলা
বেলা ২টার কিছু পর শাহীন কলেজের সামনে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার অর্ধশতাধিক মানুষ পোস্টার, ফুল নিয়ে বাঘিনীদের বরণের অপেক্ষায়। কেউ এসেছেন শিশুসন্তান নিয়ে, কেউ আবার সহপাঠীদের সঙ্গে। সময় বাড়ার সঙ্গে সে সংখ্যা বাড়তেই থাকে।
অপেক্ষাতেও মানুষের চেহারায় ছিল না কোনো বিরক্তির ছাপ। কারও হাতে পোস্টার ‘কৃষ্ণা রানী সরকার, মোদের অহংকার’, ‘সালাউদ্দিন হটাও, ফুটবল বাঁচাও’।
ওভারব্রিজে উৎসুক জনতা দেখে কেউ আবার ব্যক্তিগত গাড়ি করেই ভিডিও করছেন। সবার চোখে-মুখে যেন সাফ জয়ের আনন্দের ছাপ।
পাঁচ বছরের দুই যমজ সন্তান নিয়ে সাবিনা-সানজিদাদের দেখতে আসেন টিংকু-শাম্মী দম্পতি। সানজিদাদের দেখার পর খুশিতে আত্মহারা ওয়াইডব্লিইসিএর নার্সারির শিক্ষার্থী আয়াত আরোশা।
আয়াত নিউজবাংলাকে জানায়, ‘আমার খুব ভালো লাগছে। বড় হয়ে প্লেয়ার হব, ফুটবলার হব।’
একই সুর সহোদর আরোশার কণ্ঠে। ছোট্ট শিশু আরোশা বলে, ‘আমরা ফুটবলার হব, বিশ্বকাপ আনব। খুব ভালো লাগছে।’
আয়াত আরোশার মা শাম্মী আক্তার এ সময় নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ওদের দেখাতে নিয়ে আসলাম। বিজয়ের আনন্দটা কেমন লাগে। ওরাও যাতে বড় হয়ে দেশের জন্য এ রকম কিছু করতে পারে, সে জন্য দেখাতে নিয়ে আসলাম।’
জানালেন, নিজের বাচ্চারা যদি ফুটবলার হতে চায় তবে কোনো বাধা দেবেন না। বরং তাদের জন্য সবকিছু করবেন।
দুই বছরের শিশু গৌরব শিকদারকে কোলে নিয়ে ৫৩ বছরের গীতা রানি পাণ্ডে এসেছেন ফুটবলারদের দেখতে। সঙ্গে ছিল ছয় বছরের নাতনি। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ফুটবলারদের বিজয় দেখতে এসেছি। ভালোই লাগতেছে। বাংলাদেশের একটা সুনাম, গৌরব অর্জন।’
বিএএফ শাহীন কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মাহির আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের দেশের জন্য সাফ শিরোপা জয় একটা বড় অর্জন। আমদের ক্রিকেট দল যখন ধারাবাহিকভাবে ব্যর্থ, তখন মেয়েদের এই শিরোপা জয় বাঙালির কাছে উৎসবের মতন। অনেক দিন পর উদযাপন করার মতন কিছু একটা পাইছি। এ জন্যই আসলাম। সেলিব্রেট করার জন্য।’
মহাখালী গাড়ির ওয়ার্কশপে কাজ করেন ৬০ বছরের বৃদ্ধ সিরাজুল ইসলাম। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আইছি ফুটবলারদের দেখতে। অনেক আনন্দ হইছে তারা কাপ পাইছে। এইডাই ভালো লাগছে।’
প্রথমবারের মতো সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে শিরোপা পেল বাংলাদেশ। সাবিনা-সানজিদাদের হাত ধরে সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা ঘরে তোলে লাল-সবুজের দল।
আসরের শুরু থেকেই অপ্রতিরোধ্য ছিল বাংলাদেশ দল। প্রতিপক্ষের জালে ২৩টি গোল ঠুকে দেয়ার বিপরীতে মাত্র এক গোল হজম করতে হয়েছে বাংলাদেশকে। সেটিও ফাইনালে। এর আগ পর্যন্ত নিজেদের গোলবারে একটি বারের জন্য প্রতিপক্ষের বল আছড়ে পড়তে দেননি সাবিনা-স্বপ্নারা।