প্রকল্পের জন্য দেয়া টাকা ফেরত চাওয়া নিয়ে বগুড়া-৭ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) রেজাউল করিম বাবলুর সঙ্গে উপজেলা যুবলীগ নেতার দ্বন্দ্ব। সেই দ্বন্দ্ব থামাতে গেলে উল্টো উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দিকে নিজের পিস্তল বের করে তাক করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে বাবলুর বিরুদ্ধে।
বুধবার সকালে সাড়ে ১০টার দিকে ঘটনাটি ঘটেছে বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলা পরিষদের বারান্দায়। এদিন উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভা চলছিল। ঘটনার পরপরই এমপি ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন বলে জানা গেছে।
এমপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আত্মরক্ষায় পিস্তল বের করেছেন তিনি।
তবে যার দিকে পিস্তল তাক করা হয়েছে, সেই উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সোহরাব হোসেন ছান্নু নিউজবাংলাকে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
জানা গেছে, এমপির সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়া যুবলীগ নেতার নাম আলমগীর বাদশা। তিনি শাজাহানপুর উপজেলা যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক।
আলমগীর বাদশা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘২০১৯ সালে এমপির নামে মসজিদ, রাস্তাসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্দ আসে। ওই সময় অনেকের কাছ থেকে বরাদ্দ দেয়ার নামে টাকা নিয়েছিলেন এমপি বাবলু। আমার কাছে থেকেও ৩ লাখ ৯৫ হাজার টাকা নেন। আমিই তাকে দিয়েছিলাম; যাতে উন্নয়ন কাজগুলো হয়। কিন্তু সেই বরাদ্দ আজও দিতে পারেননি তিনি। আমার দেয়া টাকাও ফেরত দেননি।’
বাদশা অভিযোগ করেন, ‘অতীতেও টাকা ফেরতের বিষয়ে তার সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনি দিবেন বলে এড়িয়ে যেতেন। আজ সামনাসামনি দেখা হতে তাকে বললাম, আপনি যে টাকাটা নিলেন, ফেরত দিবেন না?’
‘এ কথা বলার পরেই তিনি আমার ওপর উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। বলেন কিসের টাকা, কোনো টাকা নেই।’
যুবলীগ নেতার বর্ণনায়, ‘এ সময় আমাকে ধাক্কা মারতে থাকেন এমপি। ফারুক নামে তার এক সঙ্গী লাঠি দিয়ে আঘাত করে আমাকে। আমাকে বাঁচাতে গেলে আরেক জনের মাথায় বারি মারে ফারুক। ওই সময় উপজেলা আইনশৃঙ্খলা মিটিং চলছিল। হট্টগোল শুনে উপজেলা চেয়ারম্যান সোহরাব হোসেন ছান্নু বের হয়ে সবাইকে শান্ত হতে বলেন। কিন্তু কোনো কথা না বলে এমপি পিস্তল বের করে তার দিকে তাক করে।’
প্রতক্ষদর্শীরা নিউজবাংলাকে জানান, সকাল ১০টার দিকে এমপি বাবলু আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় অংশ নিতে আসেন। এ সময় যুবলীগ নেতা আলমগীর বাদশা এমপির কাছে গিয়ে প্রকল্পের জন্য দেয়া টাকার প্রসঙ্গ তোলেন। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনামূলক কথা চলছিল। একপর্যায়ে হাতাহাতি ও ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়। এ সময় বাদশাকে লাঠি দিয়ে আঘাত করে ফারুক। সেটি ঠেকাতে গিয়ে শহিদুল নামে একজনের মাথায় আঘাত পান। হামলায় এমপির সহকারীর মাথাতেও লাঠির আঘাত লাগে।
ঘটনাস্থলে থাকা শহিদুল ইসলাম নামে উপজেলা শ্রমিক লীগের এক নেতা বলেন, ‘বাদশার পাশে দাঁড়ালে এমপির সঙ্গে থাকা ফারুক পিছন থেকে এসে লাঠি দিয়ে আমার মাথায় বারি দেয়। এখনও মাথায় ফুলে আছে। ওই ফারুক এমপির ছত্রছায়ায় মাদক ব্যবসা করে, গরু চুরি করে। পরে উপজেলা চেয়ারম্যান এগিয়ে আসলে এমপি পিস্তল বের করে দেখায়।’
ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা নেতা সোহরাব হোসেন ছান্নু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভা হচ্ছিল। বাইরে হট্টগোল শুনে বের হই। শুনতে পাই চার বছর আগের প্রকল্পের বরাদ্দের টাকা নিয়ে কথাকাটাকাটি হচ্ছে। আমি তাকে বললাম এমপি সাহেব আপনি বসে সমাধান করা ভালো। আপনি সিনিয়র মানুষ, এভাবে যুবলীগ সেক্রেটারির সঙ্গে বাইরে কথা বলার দরকার নেই।’
‘তিনি কী বুঝলেন, হঠাৎ করে পিস্তল বের করে আমার পায়ের দিকে তাক করে। এ সময় সেখানে পুলিশ, উপজেলা সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন।’
উপজেলা চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘এমপি সাহেব এর আগে কখনও উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির কোনো সভায় আসেননি। আজ কী মনে করে এসেছেন, জানি না। পরে অবস্থা বেগতিক দেখে কিছুক্ষণ পর চলে যান এমপি। আর তার বিরুদ্ধে অনেক প্রকল্প নিয়ে নয়ছয় করার ঘটনা আছে। এসবের সঠিকভাবে তদন্ত করা দরকার।’
তবে এসব ঘটনার বিষয়ে সংসদ সদস্য রেজাউল করিম বাবলুর কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তার ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরটি বন্ধ রয়েছে।
তার ব্যক্তিগত সহকারী (পিএ) রেজাউল করিমের দাবি, ঘটনাস্থলে এমপির ওপর হামলা চালানো হয়। তাই আত্মরক্ষার্থে নিজের পিস্তল বের করেছেন এমপি।
নিউজবাংলাকে পিএ বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা কমিটির মিটিংয়ে অংশ নিতে উপজেলা পরিষদে যাওয়া হয়। এ সময় সেখানে আলমগীর বাদশা এমপি মহোদয়কে দেখেই অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন। তার সঙ্গে আরও কয়েকজন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ছিলেন। একপর্যায়ে তারা এমপির ওপর হামলা করে। আমি সামনে থাকায় আমার মাথায় আঘাত লাগে।’
উপজেলা চেয়ারম্যানের দিকে পিস্তল তাক করার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘চেয়ারম্যানও হামলা করতে এসেছিলেন। এমপি তখন নিজের আত্মরক্ষায় পিস্তল বের করেন। পিস্তল তো নেয়া হয়েছে আত্মরক্ষার জন্য।’
এ বিষয়ে শাজাহানপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘আজ উপজেলায় আইন শৃঙ্খলা কমিটির সভা হয়েছে। এ সময় এমপি মহোদয়ের সঙ্গে বাইরে ঝামেলা হয়েছে।’
পিস্তলের নিবন্ধনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটি নিশ্চিত হয়ে বলতে হবে। আমি খোঁজ নিচ্ছি।’
তবে বগুড়া জেলা প্রশাসনের জেএম শাখা থেকে এমপি বাবলুর নামে একটি পিস্তল নিবন্ধনের বিষয় নিশ্চিত করা হয়েছে।
আলোচনায় এমপি
‘জিয়া পরিবারের আসন’ হিসেবে পরিচিত বগুড়া-৭ (গাবতলী-শাজাহানপুর) আসনের সংসদ সদস্য মো. রেজাউল করিম ওরফে বাবলুকে নিয়ে বিতর্ক কোনো নতুন ঘটনা নয়। এর আগেও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কাজে আলোচনায় উঠে এসেছে তিনি। তার বিরুদ্ধে হলফনামায় মামলার তথ্য গোপন করার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়াও দুদকেও রয়েছে অভিযোগ।
২০২০ সালে বেফাঁস মন্তব্য করেন এমপি বাবলু। ওই বছরের ১৭ নভেম্বর সংসদে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) বিল-২০০০’ সংসদে পাস হওয়ার সময় রেজাউল করিম বলেছিলেন, ‘নারীবাদীরা নারী স্বাধীনতার কথা বলে নারীদের উন্মুক্ত করে চলছে। এ কারণেই ধর্ষকেরা ধর্ষণের অনুভূতিকে এতটা একসেপ্ট করেছে, ধর্ষণে উৎসাহিত হচ্ছে।’
অস্ত্র হাতে ফেসবুকে ছবি দিয়ে ভাইরাল হন এমপি বাবলু। রেজাউল করিম গোলবাগীর একটি ছবি ২০২০ সালের অক্টোবরে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। ওই ছবিতে দেখা যায়, হাতে অস্ত্র নিয়ে হাসিমুখে একটি চেয়ারে বসে আছেন তিনি। পাশের টেবিলে আছে গুলির ম্যাগজিন। ছবিটি ভাইরাল হওয়ার পর নতুন করে আলোচনায় আসেন গোলবাগী।