বান্দরবানে প্রায় ৪৬৪ বর্গকিলোমিটার আয়তনের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের মধ্যে ঘুমধুমের সঙ্গে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সীমানা ১৫ কিলোমিটারেরও বেশি। এই ইউনিয়নের জনসংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার।
এই সীমান্তেই এক মাসের বেশি সময় ধরে গোলাগুলি হচ্ছে, মর্টার থেকে গোলা ছোড়া হচ্ছে। পাশাপাশি যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার থেকেও ছোড়া হচ্ছে গুলি, বোমা ও গোলা।
সব মিলিয়ে ঘুমধুম, নাইক্ষ্যংছড়ি সদর, দোছড়ি ও বাইশারী ইউনিয়নের অন্তত ২২ হাজার মানুষের স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হচ্ছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে তুমব্রু বাজার ও আশপাশের এলাকার মানুষ। ৩৩-৩২ নম্বর পিলার এলাকার মানুষের চাষাবাদ এখন পুরোপুরি বন্ধ। ব্যবসা-বাণিজ্যেও স্থবিরতা। জনমানবহীন হয়ে পড়েছে বাজারগুলো। দোকানে তেমন বেচাবিক্রি নেই। তাই অনেকে বন্ধ রেখেছেন দোকানপাট। কখন যেন উড়ে এসে পড়ে গোলা- এমন আতঙ্ক সর্বত্র।
ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের সামনের চা দোকানি মোহাম্মদ আতিক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ভোর ৫টার পর থেকে এ পর্যন্ত ৯ বার ভারী গোলার শব্দ ভেসে এসেছে। মানুষ প্রতিদিন এসব শব্দ শুনে শুনে এখন অভ্যস্ত। তাই তেমন সাড়া নেই। তবে স্কুল শিক্ষার্থী বা শিশুরা ভয় পায়।’
আতিক জানান, দোকানের বিক্রি একেবারেই কমে গেছে। মানুষজন তেমন বাড়ি থেকে বের হচ্ছে না। কিছুক্ষণ পরপর টহল দিচ্ছে বিজিবি। মানুষকে সতর্ক করছে, যেন কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে।’
তুমব্রু বাজার
তুমব্রু বাজারের ব্যবসায়ী সমিতির নেতা হামিদুল ইসলাম জানান, গোলাবর্ষণের খবরে বিভিন্ন কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিরা এখন আর আসছেন না। ফলে পণ্য সংকটও বাড়ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
মুদি দোকানি রহিম উদ্দিন বলেন, ‘নিরাপত্তা আছে বুঝেছি। তবে ব্যবসা বা মানুষজন কমে গেছে। বেচাবিক্রি নেই বললেই চলে। দিনমজুরির কাজেও যেতে পারছে না মানুষ। তাই হয়তো বেচাবিক্রি কমে গেছে।’
জেলা প্রশাসক ইয়াসমিন পারভিন বলেন, ‘ঝুঁকি বিবেচনা ও স্থানীয় বাসিন্দাদের মতামতের পর কখন তাদের সরিয়ে আনা হবে তার সিদ্ধান্ত হবে। তবে পরিস্থিতি এখনও পর্যবেক্ষণ করছে সরকার। গত কয়েক দিনের গোলাবর্ষণের পর থেকে স্থানীয় কিছু বাসিন্দাকে সরানোর পরিকল্পনাও হাতে নেয়া হয়েছে।’
জেলা প্রশাসক জানান, এসএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র সরিয়ে নেয়া হলেও শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
এ ছাড়া স্থানীয়দের সরিয়ে নেয়ার বিষয়ে জনপ্রতিনিধিদের বলা হয়েছে তাদের মতামত নিতে।
জিরোলাইনে থাকা রোহিঙ্গাদের বিষয়ে কী ভাবছে সরকার- এমন প্রশ্নে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘আপাতত বিষয়টি আমাদের হাতে নেই। আমরা শুধু আমাদের জনগণকে নিয়ে ভাবছি। তারা মিয়ানমারের নাগরিক। তাদের নিয়ে আন্তর্জাতিক মহল ভাববে।’
মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেলে সীমান্তের শূন্যরেখায় এক রোহিঙ্গা নিহতের পর টানা তিন দিন তুমব্রু সীমান্তে গোলার শব্দ শোনা যাচ্ছে।
প্রায় এক মাস ধরে নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্তে উত্তেজনা চলছে। সীমান্তের ওপারে মিয়ানমার থেকে মর্টার শেল, গোলাগুলিসহ নানা ভারী অস্ত্রের আওয়াজে এপারের ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু ও বাইশপারী এলাকার মানুষ দিন কাটাচ্ছে আতঙ্কে।
বেশ কয়েকবার মিয়ানমার রাখাইন রাজ্যের পাহাড় থেকে ছোড়া মর্টার শেল বাংলাদেশের ভূখণ্ডেও এসে পড়েছে।
সর্বশেষ শুক্রবার রাতে তুমব্রুর কোনারপাড়া সীমান্তে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ছোড়া মর্টার শেলে শূন্যরেখার রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এক যুবক নিহত হন। আহত হন শিশুসহ পাঁচ রোহিঙ্গা।
এর আগে একই দিন দুপুরে এই সীমান্তেই হেডম্যানপাড়ার ৩৫ নম্বর পিলারের ৩০০ মিটার মিয়ানমার সীমান্তের অভ্যন্তরে মাইন বিস্ফোরণে আহত হন বাংলাদেশি এক যুবক।
গত ২৮ আগস্ট তুমব্রু উত্তরপাড়ায় একটি অবিস্ফোরিত মর্টার শেল এসে পড়ে। সেদিনই সীমান্তে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার ও যুদ্ধবিমানকে চক্কর দিতে দেখা যায়।
এরপর ৩ সেপ্টেম্বর মিয়ানমারের দুটি যুদ্ধবিমান ও ফাইটিং হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া দুটি গোলা ঘুমধুম ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ড এলাকায় পড়ে। সেগুলো অবিস্ফোরিত থাকায় হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। এর তিন দিন পর ফের ওই সীমান্তে ভারী অস্ত্রের বিকট শব্দ ভেসে আসে।