ফরিদপুরে এবার বাম্পার ফলন হয়েছে পাটের। কিন্তু পাটের রং কৃষককে লোকসানের মুখে ঠেলে দিয়েছে। তবে কৃষকের মুখে কিছুটা স্বস্তির হাসি ফুটিয়েছে পাঠকাঠি। ফরিদপুরে একাধিক কার্বন ফ্যাক্টরি গড়ে ওঠায় পাটকাঠির ভালো দর পাচ্ছে কৃষক।
আগে শুধু জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হলেও এখন কদর বেড়েছে পাটকাঠির। এ কারণে এখন বাড়ি, পাকা সড়ক, মাঠঘাট যেখানে চোখ যায় সেখানেই চোখে পড়ে পাটকাঠি শুকানো ও রক্ষণাবেক্ষণের আয়োজন। অনেক কৃষক পাটের দাম খুব একটা ভালো না পেলেও পাটকাঠির দাম দিয়ে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন।
এখন দেশ থেকে পাটকাঠি বা পাটখড়ির ছাই রপ্তানি হচ্ছে। ব্যতিক্রমী এ পণ্যের রপ্তানি দিন দিন বাড়ছে। সে কারণে বাড়ছে ছাই উৎপাদনের কারখানাও। এ ছাই চারকোল নামে পরিচিত।
ফরিদপুরে গড়ে উঠেছে ডজনখানেক চারকোল কারখানা। পাটখড়ি পুড়িয়ে তৈরি করা হয় চারকোল পাউডার বা কার্বন। কার্বন থেকে তৈরি হয় কার্বন পেপার, কম্পিউটার ও ফটোকপিয়ারের কালি, আতশবাজি, মোবাইলের ব্যাটারি, প্রসাধনী পণ্য ইত্যাদি। চীনই এর মূল গন্তব্য।
ফরিদপুরের ৯ উপজেলার মধ্যে সালথাকে বলা হয় পাটের রাজধানী। এ ছাড়া নগরকান্দা, আলফাডাঙ্গা, বোয়ালমারী, মধুখালী, নগরকান্দা ও ভাঙ্গা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় পাটের আবাদ অনেক বেশি হয়।
এসব এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পাটের কাঠি আগের মতো অবহেলায় ফেলে না রেখে যত্ন করে শুকিয়ে মাচা তৈরি করে রাখছেন চাষিরা।
স্থানীয়রা জানান, পাটকাঠি কোথাও আবার পাটখড়ি নামেও পরিচিত। আগে সস্তা জ্বালানির বাইরে পাটকাঠির তেমন ব্যবহার ছিল না। আর কিছু ভালোমানের পাটকাঠি পানের বরজে আর ঘরের বেড়া তৈরিতে ব্যবহার হতো। কিন্তু এখন আর এটি মূল্যহীনভাবে পড়ে থাকে না। বিশ্ববাজারে পাটকাঠির চাহিদা বাড়ায় আঁশের পাশাপাশি কাঠির দামও ভালো পাওয়া যায়।
বোয়ালমারী উপজেলার রুপাপাত ইউনিয়নের টোংরাইল গ্রামের পাট চাষি কালি কুমার বালা বলেন, ‘কয়েক বছর আগেও পাটখড়ির তেমন চাহিদা ছিল না। কিন্তু এখন বেশ চাহিদা। দূর-দূরান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা এসে পাটকাঠি কিনছেন, ভালো দামও দিচ্ছেন। ১০০ মোটা পাটকাঠি বিক্রি হচ্ছে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায়। শুধু পাট বিক্রি করেই নয়, এবার পাটখড়িও আমাদের এলাকায় কৃষকের আশা জাগিয়েছে।’
সালথা উপজেলার বাসিন্দা বিধান চন্দ্র মণ্ডল জানান, পাটকাঠি একসময় শুধু রান্না-বান্নার জ্বালানি, ঘরের বেড়া ও ছাউনির কাজে ব্যবহার করা হতো। কিন্তু এখন এই পাটকাঠি দেশের পানের বরজে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিশেষ করে কার্বন ফ্যাক্টরির কারণে পাটকাঠির চাহিদা ও মূল্য বেড়েছে।
মধুখালী উপজেলার রায়পুর ইউনিয়নের ব্যাসদি গ্রামের শাহজাহান হেলাল বলেন, ‘পাটকাঠির ছাই বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। তাই ভালো দাম পাওয়া যাচ্ছে। পাটকাঠিকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বেশ কিছু কারখানা গড়ে উঠেছে। একদিকে সোনালি আঁশ, অন্যদিকে পাটকাঠি– দুটি মিলে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে পাট আবাদে।’
বোয়ালমারী উপজেলা কৃষক লীগের সদস্য, শিক্ষক ও সাংবাদিক কাজী আমিনুল ইসলাম জানান, বিভিন্ন দেশে পাটকাঠির ছাই কার্বন পেপার, কম্পিউটার ও ফটোকপি মেশিনের কালি, আতশবাজি ও ফেসওয়াশের উপকরণ, মোবাইলের ব্যাটারি, প্রসাধনী পণ্য, এয়ারকুলার, পানির ফিল্টার, বিষ ধ্বংসকারী ওষুধ, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, দাঁত পরিষ্কারের ওষুধ ও ক্ষেতের সার উৎপাদনের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ কারণে প্রতিনিয়ত পাটকাঠির চাহিদা দেশের পাশাপাশি বাড়ছে বিশ্ববাজারেও।
যশোর, সাতক্ষীরা এলাকা থেকে আসা পাটকাঠি ব্যবসায়ী কাদের সেখ, সিদ্দিকুর রহমান জানান, তারা ৮-১০ বছর ধরে পাটকাঠির ব্যবসা করছেন। আগে ফরিদপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাটকাঠি কিনে বেশি দামে বিক্রি করতেন তারা। এখন জেলায় প্রায় এক ডজন কার্বন ফ্যাক্টরি গড়ে উঠেছে। এই অঞ্চলের পাটকাঠি দিয়ে এসব ফ্যাক্টরির চাহিদা মেটানোই কষ্টসাধ্য। তাই তারা আর আগের মতো পাটকাঠি কিনতে পারেন না। কারণ বর্তমানে পাটকাঠির দাম ও চাহিদা দুটোই বেশি। অনেকেই এখন পাটকাঠির ব্যবসা করে জীবকা নির্বাহ করছেন।
ফরিদপুরের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. জিয়াউল হক বলেন, ‘জেলায় এবার মোট ৮৭ হাজার হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ হয়েছে। পাটের রং না আসায় এবং বড় কিছু মিল বন্ধ থাকার কারণে পাটের বাজারে দাম কম। এতে কৃষকরাও বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তবে কৃষকের ক্ষতি পুষিয়ে দিচ্ছে এই পাটকাঠি। কার্বন ফ্যাক্টরিগুলোর কারণে পাটকাঠির চাহিদা বেড়েছে।’
ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক অতুল সরকার বলেন, "গুণে ও মানে ফরিদপুরের পাট দেশ সেরা। এ কারণে জেলার ব্র্যান্ডিং পণ্য হিসেবে পাটকেই বেছে নেয়া হয়েছে। ফরিদপুর জেলার স্লোগান হলো: 'সোনালি আঁশে ভরপুর, ভালোবাসি ফরিদপুর।' পাটের সোনালি আঁশের পাশাপাশি পাটকাঠিরও বেশ চাহিদা রয়েছে।"