বান্দরবান সীমান্তে গোলাবর্ষণের অভিযোগ অস্বীকার করে মিয়ানমার এর দায় ঠেলে দিয়েছে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত রাখাইন রাজ্যের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির প্রতি।
দেশটির দাবি, আরাকান আর্মি মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গোলাবারুদ চুরি করে বাংলাদেশে গুলি করছে, যাতে করে দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি হয়, বাংলাদেশ মিয়ানমারকে অবিশ্বাস করে।
সীমান্তে গোলাবর্ষণের প্রতিবাদে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত অং কিউ মোয়েকে তলব করার পর তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এসে এই ব্যাখ্যা দিয়ে গেছেন বলে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
রোববার বিকেলে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব খোরশেদ আলম সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন।
বাংলাদেশ সীমান্তের ওপারে বেশ কিছুদিন ধরে বিদ্রোহী আরাকান আর্মির সঙ্গে লড়াই চলছে মিয়ানমার সেনাদের। এ লড়াইয়ের মধ্যে মিয়ানমার সেনাদের ছোড়া বেশ কিছু মর্টার শেল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এসে পড়ে।
সর্বশেষ শুক্রবার রাতে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু কোনারপাড়া সীমান্তে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ছোড়া চারটি মর্টার শেল এসে পড়ে। এতে শূন্যরেখার রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এক যুবক নিহত হন। আহত হন রোহিঙ্গা শিশুসহ পাঁচজন।
সীমান্তে মর্টার শেল বিস্ফোরণে নিহত ও আহতের ঘটনার ব্যাখ্যা জানাতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত। ছবি: সংগৃহীত
এসব ঘটনায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে মোট চারবার তলব করে প্রতিবাদ জানিয়েছে ঢাকা। সর্বশেষ তলব করা হয় রোববার সকালে।
মিয়ানমারের দূত কী বলেছেন, সেটি তুলে ধরে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব জানান, অং কিউ মোয়ে দাবি করেছেন, এগুলো (গোলাবর্ষণ) আসলে এটা একটা দুর্ঘটনা।’
রাষ্ট্রদূতের বরাত দিয়ে ভারপ্রাপ্ত সচিব বলেন, ‘মিয়ানমার আর্মি বলছে আরাকান আর্মি তাদের গুলি-অস্ত্র চুরি করে বাংলাদেশে গুলি করছে। যাতে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের অবনতি হয়। বাংলাদেশ যাতে মিয়ানমারকে অবিশ্বাস করে। আসলে কে দায়িত্ব নেবে, তা নিরূপণ করা আসলে কঠিন। তারা খারাপ উদ্দেশ্য নিয়েও গোলা পাঠিয়ে থাকতে পারে।
‘তারা (মিয়ানমার) অনেক সময় এটাও বলে থাকে বা এমন দোষও দেয়, আরাকান আর্মি আমাদের এখান থেকে গিয়ে হামলা করে।’
ঢাকার উদ্বেগের বিষয়ে মিয়ানমারের দূত কী বলেছেন- এই বক্তব্য তুলে ধরে খোরশেদ আলম বলেন, ‘রাষ্ট্রদূত আমাদের তেমন কিছু জানাননি। উনি জানিয়েছেন, আমাদের এই বক্তব্যগুলো নেপিডোকে জানাবেন।’
মিয়ানমারকে বাংলাদেশ কী বার্তা দিয়েছে
এই প্রশ্নে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘আমরা বলেছি, হ্যাঁ, এটা আপনাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। আপনারা এটা সামলাবেন। এটা যেন কোনোভাবেই বাংলাদেশের সীমান্তের এপারে ছড়িয়ে না পড়ে। এ বিষয়ে সতর্ক হবেন।
‘এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা মিয়ানমারকেই গ্রহণ করতে হবে। এটা তাদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারের কোনো গোলা যেন আমাদের দেশে না আসে, সেটা দেখার দায়িত্ব আমাদের না। সেটা সেখার দায়িত্ব মিয়ানমারের। বাংলাদেশ সব সময়ই দায়িত্বশীল ও শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্র। আমরা অনেক দিনই ধৈর্য ধরে এই বিষয় দেখে আসছি।
‘আমরা তাদের বলেছি, আপনারা দ্রুত আপনাদের সমস্যা সমাধান করুন। যাতে আমাদের এখানে আর রক্তারক্তি না হয়। আমাদের এখানে যেন কোনো প্রাণ আর না যায়।’
সচিব বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে আমরা যে বক্তব্য ও বিবৃতি দিয়েছি, তাতে কোনো উইকনেস বা দুর্বলতা নেই। যা অনেকেই নতজানু বলে থাকে তার কোনো কিছুই আমাদের বক্তব্যে নেই। সেই ধরনের কথাই আমরা বলছি, যা আমাদের শক্ত অবস্থানকেই তুলে ধরে।’
এখনও সেনা মোতায়েন নয়
সীমান্তে মিয়ানমার সেনা মোতায়েন করলেও এপারে এখনও সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি দিয়েই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে চাইছে বাংলাদেশ। আপাতত এর বাইরে কোনো পদক্ষেপ না নেয়ার কথা বললেন পররাষ্ট্র সচিব। জানান, সীমান্তে এখনই সেনা মোতায়েনের কথা ভাবা হচ্ছে না।
বান্দরবানের তুমব্রু সীমান্ত। ফাইল ছবি
তিনি বলেন, ‘সকল গোয়েন্দা সংস্থা, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও কোস্টগার্ডকে সতর্ক করা হয়েছে। মিয়ানমার থেকে যেকোনো ধরনের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে প্রয়োজনীয় সদস্য মোতায়েনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
‘আমরা আজ উচ্চপর্যায়ের একটা মিটিংও করেছি। বাংলাদেশের যত প্রকার এজেন্সি আছে, তাদের নিয়ে। আমরা বিজিবি ও কোস্টগার্ডকে বলে দিয়েছি বর্ডারে সজাগ থাকতে। তারা তাদের প্রয়োজনমতো সদস্য যেখানে যতটুকু প্রয়োজন তা মোতায়েন করবে। এ ছাড়া কোস্টগার্ডকে বলেছি, সাগর দিয়েও যেন কোনো রোহিঙ্গা বা অন্য কারও কোনো অনুপ্রবেশ না ঘটে।’
আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোকে ব্রিফ করবে বাংলাদেশ
মিয়ানমারের এই আচরণ নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ানেও যাবে বাংলাদেশ।
ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘আসিয়ানের যে রাষ্ট্রদূতরা ঢাকায় আছেন তাদের ডেকে এই ঘটনার ব্র্রিফ করারও সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যাতে তাদের আমরা জানাতে পারি। বারবার প্রতিবাদ জানিয়েও মিয়ানমারের সমস্য সমাধান করা যাচ্ছে না।
‘মিয়ানমার এই বিষয়ে যে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না, এটা আমাদের জন্য দুঃখজনক। প্রতিবেশী হিসেবে আমরা চাই না এর পুনরাবৃত্তি ঘটুক। আমরা এভাবে এসব ঘটনা থেকে কীভাবে মিয়ানমারকে বিরত রাখা যায়, সেই চেষ্টা চালিয়ে যাব।’