একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আগের রাতে ভোট হয়ে যাওয়ার যে অভিযোগ ছিল, সেটি ফুটে উঠেছে একজন নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্যে।
বর্তমান নির্বাচন কমিশন যে ব্যালটের পাশাপাশি ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনেও ভোট নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার বিরোধিতাকারীদের বক্তব্যের জবাব দিতে গিয়ে কমিশনার মো. আলমগীর প্রসঙ্গটি তোলেন।
তিনি বলেছেন, ‘আপনারা কি চান আবারও ব্যালটে ভোটের মাধ্যমে সেই সেহরি, ইফতারি খাক?’
রোববার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি এসব কথা বলেন।
নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘আপনারাই তো বলেন যে, রাতে ভোট হয়, সকালে ভোট হয়, দুপুরে ভোট হয়, সেহরি খায়, ইফতারি খায়। আপনারা কি চান আবারও ব্যালটে ভোটের মাধ্যমে সেই সেহরি, ইফতারি খাক?’
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটের আগের রাতেই কেন্দ্রে কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের মার্কা নৌকার পক্ষে সিল দেয়ার অভিযোগ করেছে বিরোধী জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। সে সময়ের প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা তার মেয়াদের শেষে এসে বলেন, রাতে ভোটের বিষয়ে কেউ তাদের কাছে অভিযোগ করেনি।
গত ফেব্রুয়ারির শেষে নতুন নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল রাতে ভোটের অভিযোগটি এক প্রকারে মেনেই নেন।
গত ২৫ মে তিনি বলেন, ‘কমিশন থেকে আমরা বলব, ভোট নিয়ম অনুযায়ী হবে। দিনের ভোট দিনেই হবে। ভোট রাতে হবে না- এটা আমরা স্পষ্ট করে বলছি।’
নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর মনে করেন, ইভিএমে ভোট হলে নির্বাচন নিয়ে এই ধরনের অভিযোগগুলো আর আসবে না।
ইভিএম-বিরোধীদের অভিযোগের জবাব
ইভিএম নিয়ে যেসব সংশয়ের কথা বিরোধীরা তুলে ধরছেন, সেগুলোর কোনো ভিত্তি নেই বলে মনে করেন মো. আলমগীর।
তিনি বলেন, ‘ভোটার তালিকার সঙ্গে ইভিএমে ফটোও দেখা যায়। কাজেই কারও আঙুলের ছাপ না মিললেও একজনের ভোট অন্যজন দেয়ার সুযোগ নেই। কারও আঙুলের ছাপ না মিললে সেই ফটো মিলিয়ে দেখা হয়। সব দিক থেকেই আমরা নিশ্চিত হয়েছি ইভিএমে কারচুপি করা যায় না।’
ইভিএমে পেপার ট্রেইল না থাকার যে বিষয়টি বিরোধীরা তুলে ধরছেন, তার জবাবে এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘আমরা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গেও কথা বলেছি। তারা আমাদের বলেছেন, এই মুহূর্তে এটা সংযোজন করা সম্ভব নয়।’
ইভিএম নিয়ে সংলাপে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর বক্তব্য কি পাল্টেছে ইসি?
নির্বাচন কমিশন সর্বোচ্চ দেড় শ আসনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে যুক্তি দেখিয়েছে যে, ১৭টি দল এই যন্ত্রের পক্ষে কথা বলেছে। তবে একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ইভিএমের বিরোধিতাকারী কয়েকটি দলের বক্তব্য পাল্টে দিয়েছে কমিশন।
এই বিষয়ে ওঠা প্রশ্নেরও জবাব দেন মো. আলমগীর। তিনি বলেন, ‘দলগুলোর সঙ্গে যে সভা করেছি, তা আপনারা সরাসরি দেখেছেন। আমাদের কর্মকর্তারা এগুলো লিপিবদ্ধ করেছেন, ভিডিও ক্লিপ আছে। সেগুলো দেখে আমাদের লিখিতভাবে দিয়েছেন। তিনবার মিলিয়ে দেখা হয়েছে। আমরা দলগুলোর লিখিত বক্তব্য এবং ভিডিও ক্লিপের ভিত্তিতে ইভিএম নিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
‘আর অনেকেই বলেছেন, যদি কারচুপি করা না যায়, তবেই ইভিএম চায় তারা। কাজেই সেই হিসেবেই আমরা দেখেছি মোট ১৭টি দল ইভিএম চায়।’
তবে অভিযোগ যেহেতু এসেছে, সেহেতু এটি খতিয়ে দেখার কথাও বলেন এই নির্বাচন কমিশনার। বলেন, ‘যেহেতু পত্রিকায় এসেছে, আমরা দেখব আমাদের কোনো ভুলত্রুটি আছে কি না। যদি ভুল থাকে আমরা সংশোধন করব। ১৭০ জিবি রেকর্ড আছে আমাদের কাছে। অনেকেই লিখে নিয়ে এসেছেন বিপক্ষে, কিন্তু আলোচনা পর মাইন্ড চেঞ্জ করেছেন, আমরা তাদের পক্ষে রেখেছি।’
বর্তমান কমিশনের অধীনে এখন পর্যন্ত স্থানীয় সরকারের যেসব এলাকায় ভোট হয়েছে, তার সবগুলোই হয়েছে ইভিএমে। এসব নির্বাচন নিয়ে বলার মতো কোনো অভিযোগ ওঠেনি।
এ বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়ে মো. আলমগীর বলেন, ‘যেখানে ইভিএম হয়েছে, সেখানেই কোনো মারামারি, রক্তপাত হয়নি, কোনো কারচুপি হয়নি এবং একটি নির্বাচন নিয়েও কোনো অভিযোগ আসেনি, চ্যালেঞ্জ করা হয়নি। তাই সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে আমরা ইভিএম নিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
‘এটা আমাদের সিদ্ধান্ত- ১৫০ আসনে যদি নির্বিঘ্নে ভোট নিতে পারি, বাকি ১৫০ আসনে ব্যালটে হলে যেন প্রয়োজনীয় ফোর্স মোতায়েন করতে পারি, সেভাবেই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
ইভিএমে ভোট হলে যদি ভোট সুষ্ঠু করা যায় তাহলে ৩০০ আসনের সবগুলোতেই কেন এই যন্ত্র ব্যবহার করা হবে না, এমন প্রশ্ন ছিল নির্বাচন কমিশনারের প্রতি। জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের টাকা দেন, তাহলে ৩০০ আসনেই ইভিএম করব। এ ছাড়া প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা যদি করতে পারেন, আমরা ৩০০ আসনেই করব।’
কমিশনের হাতে যতগুলো ইভিএম আছে, সেগুলো দিয়ে দেড় শ আসনে ভোট করা সম্ভব নয়। কমিশন হিসাব করে দেখেছে, ৭০ থেকে ৮০টি আসনে ইভিএমে ভোট করা সম্ভব। এ কারণে আরও মেশিন কিনতে চায় নির্বাচন কমিশন। তবে এ বিষয়ে প্রস্তাব তৈরি করলেও কমিশনের প্রস্তাব সরকার অনুমোদন করে কি না এ নিয়ে সংশয় আছে।
নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাব সোমবার চূড়ান্ত হবে বলেও জানান মো. আলমগীর। পরে তা পাঠানো হবে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি- একনেকে।