চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের ঘটনায় ডিএনএ পরীক্ষায় নতুন করে দুই মরদেহের পরিচয় শনাক্ত হয়েছে। নতুন শনাক্ত হওয়া দুই মরদেহের একটি নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার হেদায়েত উল্লাহর ছেলে মাইনুদ্দিনের।
২১ বছর বয়সী মাইনুদ্দিন কাভার্ড ভ্যান চালাতেন। তার বাবাও গাড়ির চালক। বিস্ফোরণের পর থেকে হন্যে হয়ে ছেলেকে খুঁজছেন বাবা হেদায়েত উল্লাহ। চাকরি ছেড়ে তিন মাস ধরে ঘুরছেন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বিএম কনটেইনার ডিপো, জেলা প্রাশাসন কার্যালয়সহ বিভিন্ন জায়গায়।
তিন মাসে ছেলেকে খুঁজতে এই দৌড়ঝাঁপে খরচ হয়েছে অন্তত ২ লাখ টাকা। এর মধ্যে নিজের জমানো ৫০ হাজার ছাড়া বাকি টাকা তাকে চড়া সুদে ধার নিতে হয়েছে।
বৃহস্পতিবার ছেলের মরদেহ শনাক্তের খবর শুনে চট্টগ্রাম আসেন হেদায়েত উল্লাহ। মরদেহ নেয়ার খরচ জোগাতেও এলাকার এক ব্যক্তির কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা সুদে ১৫ হাজার টাকা ধার নিয়েছেন তিনি। কিন্তু এই টাকায় অ্যাম্বুলেন্স না পাওয়ায় বাধ্য হয়ে পিকআপ ভ্যানে করে মরদেহটি চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নিতে হয়েছে।
হেদায়েত উল্লাহ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ছেলেকে খুঁজতেছি তিন মাস ধরে। সব মিলিয়ে ১০২ দিন। এর মধ্যে বিএম ডিপোতে গেছি অন্তত ৫০ দিন। চট্টগ্রাম মেডিক্যালে অনেক খুঁজেছি। চট্টগ্রামের ডিসি অফিসে গেছি তিনবার, থানায় গেছি, আমাদের (নোয়াখালীর) ডিসির কাছে গেছি, এমপির কাছে গেছি। সবাই শুধু আশ্বাস দিয়েছে। নিজের জমানো যা ছিল খরচ করে সুদের ওপর টাকা নিতে হয়েছে ১ লাখ ৪০ হাজারের মতো।’
ছেলের মরদেহ পাওয়ায় সন্তুষ্টির কথা জানিয়ে নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘সকালে ছেলের দাফন হয়েছে। এখন তার কবর জিয়ারত করে বাসায় যাচ্ছি। এত টাকা গেছে, তবু আমার আপসোস নাই। ছেলের লাশটা অন্তত পাইছি। জানাজা পড়তে পারছি, কবর দিতে পারছি।
‘কোনো একদিন কাজকর্ম করে ঋণ শোধ করব। আল্লাহ তো রথ (শক্তি) দিছে। কাজ করে শোধ করে দেব।’
ছেলের সঙ্গে শেষ দেখা হওয়ার বিষয়ে হেদায়েত বলেন, ‘তার সাথে আমার দেখা হয়েছিল ইদের পরের দিন। মানে ৩ মে। এরপর সে বাড়িতে গিয়েছিল, আমি যাইনি। যেদিন ঘটনা, ওইদিন রাত ১০টায় ইমোতে কল দিয়ে আমাকে দেখিয়েছিল আগুন। আমি বলছি- দূরে থাকো।
‘আমি ব্যস্ত ছিলাম, আর কথা হয়নি। পরে ১২টার দিকে কল দিয়ে তারে আর পাই না। চট্টগ্রামে আরেকজনকে কল দিয়ে শুনি ডিপোতে বিস্ফোরণ হয়েছে। আমি তখনই রওনা দিই। সকালে চট্টগ্রাম পৌঁছি। তখন থেকেই তারে খোঁজা শুরু করছি।’
বিস্ফোরণে নিহত মাইনুদ্দিনের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ না দেয়ার বিষয়টি অবহিত করা হয় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনকে। এ বিষয়ে এনডিসি মো. তৌহিদুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম মেডিক্যাল থেকে মরদেহ গেছে আমরা জানতাম না। আমাদের কেউ জানায়নি। এ বিষয়ে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা ভালো জানবেন।’
এদিকে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার সাড়া পাওয়া যায়নি।
নিখোঁজ বা নতুন শনাক্ত মরদেহের পরিবারকে ক্ষতিপূরণের বিষয়ে জানতে স্মার্ট গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) শামসুল হায়দার সিদ্দিকী এবং বিএম ডিপোর মহাব্যবস্থাপক নাজমুল আক্তার খানেরও সাড়া মেলেনি।
এদিকে বিস্ফোরণের তিন মাস পেরিয়ে গেলেও পুলিশের দায়ের করা মামলার কোনো অগ্রগতি হয়নি। ঘটনার পর চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল পরিদর্শনে এসে কেউ দায়ী হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। ঘটনার তিন দিন পর ডিপোর আট কর্মকর্তাকে আসামি করে একটি মামলা করেন সীতাকুণ্ড থানার এসআই আশরাফ সিদ্দিকী।
সেই মামলায় তিন মাসেও কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। এ বিষয়ে সীতাকুণ্ড থানার ওসি আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘আসামিরা পলাতক। এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। ঘটনাটি তদন্তাধীন।’
নেদারল্যান্ডস ও বাংলাদেশের যৌথ মালিকানাধীন (জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানি) প্রতিষ্ঠান বিএম কনটেইনার ডিপো সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারী এলাকায়। বাংলাদেশে এর মালিকানা স্মার্ট গ্রুপের। গ্রুপের চেয়ারম্যান মুস্তাফিজুর রহমানই ডিপোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক। পরিচালক হিসেবে রয়েছেন তার ছোট ভাই মুজিবুর রহমান।
এই ডিপোতে গত ৪ জুন রাত ৯টার দিকে আগুন লাগে। রাত ১১টার দিকে প্রথম বড় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।
একে একে ছুটে যায় চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের ১৫টি ইউনিট। নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর জেলা থেকেও পরে যোগ দেয় কয়েকটি ইউনিট। ৫ জুন সকাল পর্যন্ত আগুন নেভাতে আসা ইউনিটের সংখ্যা বেড়ে হয় ২৫টি। কিন্তু কনটেইনারে থাকা রাসায়নিক পদার্থের কারণে দফায় দফায় বিস্ফোরণে বাড়ে আগুনের ভয়াবহতা।
আগুন লাগার ৮৭ ঘণ্টা পর ৮ জুন দুপুরে বিএম কনটেইনার ডিপোর আগুন নেভে। আগুন ও বিস্ফোরণের ঘটনার প্রথম দুই দিনে ৪১টি মরদেহ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ। পরে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মারা যান আরও চারজন।
এ ছাড়া জুলাই পর্যন্ত বিভিন্ন সময় দেহাবশেষ পাওয়া গেছে ছয়জনের। সব মিলিয়ে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ৫১ জন হিসাব করা হয়েছে।
নতুন করে শনাক্ত হওয়া মরদেহ তিনটি হলো আবুল হাশেম, মাইনুদ্দিন ও মো. জুয়েলের। এর মধ্যে আবুল হাশেমের এক পা বিহীন মরদেহ ঘটনার পর পরই শনাক্ত করে দাফন করা হয়। কিন্তু বিচ্ছিন্ন অবস্থায় একটি পা পেয়ে তা একটি মরদেহ ধরেই ডিএনএ পরীক্ষা করে সিআইডি। সেই হিসেবে একটি মরদেহ বাদ দিলে এখন পর্যন্ত বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ৫০ জন।