বরিশালের সরকারি ব্রজমোহন কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী মালিহা জাহান। ক্যাম্পাসের লাইব্রেরির সামনে গত ২ আগস্ট দুপুর ১২টার দিকে আড্ডা দিচ্ছিলেন চার সহপাঠীকে নিয়ে।
সে সময় চতুর্থ বর্ষের ছাত্র ও অশ্বিনী কুমার ছাত্রাবাসের আবাসিক ছাত্রলীগ কর্মী সুমন ডাকুয়ার নেতৃত্বে ১০ জনের একটি দল নানা অজুহাত দেখিয়ে তাদের জিম্মি করে।
অনৈতিক কর্মকাণ্ড চলছে, এমন কথা বলে ভিডিও করতে থাকেন সুমন ডাকুয়া। ভয়ভীতি দেখিয়ে মালিহা ও তার সহপাঠীদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয় ২১ হাজার টাকা।
তখন বিষয়টি কলেজ কর্তৃপক্ষকে বলেও কোনো সমাধান মেলেনি।
ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শী কলেজের শিক্ষার্থীরা বলছেন, সুমন ডাকুয়ার নেতৃত্বে এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে অহরহ। অনেকে কলেজ কর্তৃপক্ষকে জানালেও বেশির ভাগই ভয়ে মুখ খোলেনি।
ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, অস্ত্র দিয়েও ভয় দেখাতেন সুমন। সঙ্গী হিসেবে এক ব্যক্তিকে রাখা হতো সাংবাদিক পরিচয়ে। তার কাছে একটি ক্যামেরাও ছিল।
তবে এবার সুমন পড়েছেন ‘মালির ঘাড়ে’। তিনি ও তার চক্র বুধবার রাতে বিএম কলেজের সামনে জালাল আহম্মেদ লেনে পুলিশের কনস্টেবল আনিসুর রহমানকে জিম্মি করেন বলে তথ্য মিলেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাত ১১টার দিকে সুমন ডাকুয়া ঘটনাস্থলে গিয়ে আনিসুর রহমানের কাছে ৫০ হাজার টাকা দাবি করেন। একপর্যায়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে পুলিশ সদস্যদের কোপানোর হুমকি দেন তিনি। হল থেকে ছাত্রদের ডাকেনও তিনি। পরে পুলিশ সুমনসহ চারজনকে আটক করে নিয়ে যায়।
বরিশাল কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আজিমুল করিম জানান, ওই ঘটনায় মামলা করা হয়েছে ছয়জনের বিরুদ্ধে, অজ্ঞাতপরিচয় আসামি আছে আরও দুই-তিনজন।
যাদের নাম আছে, তারা হলেন অশ্বিনী কুমার ছাত্রাবাসের এ ব্লকের ৩১৯ নম্বর কক্ষের ছাত্র সুমন ডাকুয়া, বিএম কলেজের সামনে হাজি জালাল আহম্মেদ লেনের বানাত মঞ্জিলের ভাড়াটিয়া পারভেজ হাওলাদার, হাজি জালাল আহম্মেদ লেনের আবুল কালাম সাহেবের ভবনের ভাড়াটিয়া তানিয়া আক্তার ও রিমা আক্তার।
গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হলে বৃহস্পতিবার বিকেলে তাদের কারাগারে পাঠান বিচারক। বায়জিদ, রোহানসহ দুই-তিনজন আসামি পলাতক রয়েছেন জানিয়ে ওসি বলেন, ‘তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।’
পুলিশ জানায়, দুই মাস আগে থেকে ফেসবুকে তানিয়া আক্তারের সঙ্গে পরিচয় হয় কনস্টেবল আনিসুর রহমানের। বুধবার আনিসুর মোবাইল মেরামত করতে এলে কথা হয় দুজনের।
তানিয়ার সঙ্গে দেখা করতে তার কথামতো আনিসুর বিএম কলেজের সামনে আবুল কালামের ভবনের নিচতলার ফ্ল্যাটে যান। সুমন ডাকুয়াসহ অন্যরা ওই ফ্ল্যাটে অবস্থান করছিলেন।
পুলিশের ভাষ্যমতে, আনিসুর ফ্ল্যাটে ঢোকার পর পরই তাকে মারধর শুরু করেন। তার কাছে ৫০ হাজার টাকা দাবি করেন সুমন ও অন্যরা। সঙ্গে থাকা ৩ হাজার টাকা ছিনিয়েও নেন সুমন।
পরে হত্যার ভয় দেখিয়ে দুজন মোটরসাইকেলে করে এসে আনিসুরকে বিএম কলেজের সামনের পূবালী ব্যাংকের এটিএম বুথে নিয়ে যান। বুথ থেকে আরও ২ হাজার টাকা সুমনদের হাতে দেন আনিসুর।
এরপর আরও টাকা দাবি করলে আনিসুরের ভাই হামিদুর রহমান সুজন বিকাশে ৫ হাজার টাকা পাঠান আরাফা স্টোর নামে একটি দোকানে।
বিষয়টি নিয়ে সুজনের সন্দেহ হলে তিনি বিএম কলেজের সামনে আরাফা স্টোরের সামনে অবস্থান নেন। তখন আসামি পারভেজ হাওলাদার বিকাশে পাঠানো টাকা ওঠাতে এলে তাকে ধরে পুলিশে দেন সুজন।
পরে পারভেজের দেয়া তথ্যমতে ঘটনাস্থলে গিয়ে আনিসুরকে উদ্ধার করে আরও তিনজনকে আটক করা হয়। তবে কয়েকজন পালিয়েও যায়।
ওসি আজিমুল করিম বলেন, ‘আসামিদের বিষয়ে আমরা খোঁজখবর নিচ্ছি। ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করা হচ্ছে।’
কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, বিএম কলেজের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র সুমন ডাকুয়া প্রথমে বরিশাল জেলা ছাত্রলীগের এক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে থাকতেন। প্রায় এক বছর আগে থেকে তিনি জেলা ছাত্রলীগের এক সহসভাপতির সঙ্গে মিশতে শুরু করেন কলেজ ক্যাম্পাসে অবৈধ কার্যকলাপ অব্যাহত রাখতে।
জেলা ছাত্রলীগের ওই সহসভাপতির নাম ভাঙিয়ে এসব করার বিষয়টি প্রকাশ হওয়ার পর ছাত্রলীগের ওই নেতা সুমন ডাকুয়াকে সবার সামনে জুতাপেটাও করেন।
সুমন ডাকুয়া অশ্বিনী কুমার হলে মাদক সেবন ও কারবারের সঙ্গে জড়িত বলেও জানিয়েছেন ওই হলের আবাসিক ছাত্ররা।
বরিশাল সরকারি ব্রজমোহন (বিএম) কলেজের অধ্যক্ষ গোলাম কিবরিয়া বলেন, ‘সুমন ডাকুয়ার বিষয়ে আমার কাছে এর আগে অনেকগুলো মৌখিক অভিযোগ এসেছিল। আমি তাকে ডেকে সতর্ক করেছিলাম।
‘বুধবার রাতে যে ঘটনা ঘটেছে সেটা আমি শুনেছি। অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’