হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে লেখক রামনাথ বিশ্বাসের বাড়ি দখলে রাখা আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল ওয়াহেদ মিয়াকে পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।
স্বাধীনতাবিরোধী পরিবারের সদস্য হওয়ায় তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক এ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানিয়েছে উপজেলা আওয়ামী লীগ।
ওয়াহিদ মিয়া ছিলেন বানিয়াচং ২ নম্বর উত্তর-পশ্চিম ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি।
নিউজবাংলায় গত সোমবার প্রকাশ হওয়া প্রতিবেদনে আলবদর বাহিনীর সঙ্গে ওয়াহেদের পরিবারের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি সামনে আসে। এরপর বুধবার রাতে তাকে অব্যাহতি দেয়ার বিষয়টি বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানিয়েছেন বানিয়াচং উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. আমীর হোসেন ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আঙ্গুর মিয়া।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সম্প্রতি উপজেলা আওয়ামী লীগ জানতে পারে, ওয়াহেদ মিয়া ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে বিরোধিতাকারী আলবদর বাহিনীর পরিবারের সদস্য। তাই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের শুদ্ধি অভিযানের অংশ হিসেবে আবদুল ওয়াহেদ মিয়াকে সভাপতির পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, সেখানে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মো. ময়না মিয়াকে।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. আমীর হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সম্প্রতি আমরা জানতে পেরেছি, তিনি (ওয়াহেদ) ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে বিরোধিতাকারী পরিবারের সদস্য। তার বড়ভাই আবু ছালেক মিয়া ছিলেন আলবদর বাহিনীর অন্যতম সদস্য। তাই তাকে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।
‘ওয়াহেদ বানিয়াচংয়ের বিখ্যাত রামনাথ বিশ্বাসের বাড়িটিও দখল করে রেখেছেন। এছাড়া তিনি সাংবাদিকের ওপরও হামলা করেছেন। আমরা চাই এই বাড়িটি ওয়াহেদের কবল থেকে উদ্ধার হোক।’
বাইসাইকেলে কয়েকবার বিশ্বভ্রমণকারী ও ভ্রমণ কাহিনির লেখক রামনাথ বিশ্বাসের বাড়ি বেদখলের বিষয়ে প্রতিবেদন করতে গিয়ে বেশ কয়েকবার ওয়াহেদ ও লোকজনের হামলার শিকার হয়েছেন সংবাদকর্মীরা।
সবশেষ হামলার মুখে পড়েন বিডিনিউজের স্পেশাল অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর রাজীব নূর, বানিয়াচং প্রেস ক্লাবের সভাপতি ও কালের কণ্ঠের বানিয়াচং প্রতিনিধি মোশাহেদ মিয়া, হবিগঞ্জ সমাচার পত্রিকার বানিয়াচং প্রতিনিধি তৌহিদ মিয়া এবং দেশসেবা পত্রিকার বানিয়াচং প্রতিনিধি আলমগীর রেজা।
যেভাবে বেদখল রামনাথের বাড়ি
হবিগঞ্জের বানিয়াচং গ্রামের বিদ্যাভূষণপাড়ায় ১৮৯৪ সালের ১৩ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন রামনাথ বিশ্বাস। তিনি ছিলেন চিরকুমার।
রামনাথ বিশ্বাস বাইসাইকেলে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরেছেন তিনবার। সেসব অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন ভ্রমণবিষয়ক ৪০টি বই। ১৯৫৫ সালের ১ নভেম্বর কলকাতায় তিনি মারা যান।
রামনাথ বিশ্বাসের ভ্রমণ কাহিনি নিয়ে প্রকাশিত বই
বানিয়াচং গ্রামের বিদ্যাভূষণপাড়ায় অনেক বড় এলাকা নিয়ে রামনাথের বসতভিটা। ৪ একর ৪৮ শতাংশ জমিতে বসতঘরের পাশাপাশি ছিল দৃষ্টিনন্দন মন্দির ও পুকুর। বর্তমানে পুরোনো সব ভবন ভেঙে ফেলেছে দখলদার ওয়াহেদ মিয়ার পরিবার। শুধু মন্দিরের একটি অংশ এখনও টিকে আছে। সেটিও ধীরে ধীরে ভাঙা হচ্ছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
ওই এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, বাড়িজুড়ে বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা আর সবুজ লতাপাতা। পুকুরে দখলদাররা চাষ করছেন মাছ।
স্থানীয়রা জানান, রামনাথ ভারতে স্থায়ীভাবে চলে যাওয়ার পর দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত ছিল বাড়িটি। ১৯৮০-এর দশকে ওয়াহাব উল্লাহ নামে প্রভাবশালী একজন এই সম্পত্তি দখল করে নেন। ২০০০ সালের পর তিনি আবদুল ওয়াহেদের কাছে জায়গাটির দখল বিক্রি করেন।
আবদুল ওয়াহেদ ও তার বড় ভাই আবু ছালেকের দখলে সেই থেকে রয়েছে বাড়িটি। আবু ছালেকের বিরুদ্ধে একাত্তরে আলবদর বাহিনীর সদস্য হিসেবে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ রয়েছে। আর বাড়ির দখল নেয়ার সময় আবদুল ওয়াহেদ বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হলে আবু ছালেক এলাকা ছাড়েন। অন্যদিকে রামনাথ বিশ্বাসের বাড়ি দখলে রাখতে আবদুল ওয়াহেদ নিজের নামে ভুয়া নামজারি করে নেন। তবে স্থানীয় সাংস্কৃতিক কর্মী ও রামনাথ স্মৃতি সংসদের নেতাকর্মীরা বিষয়টি প্রশাসনের নজরে আনলে সেই নামজারি বাতিল হয়।
বাড়ির দখল রাখতে রাতারাতি আওয়ামী লীগ নেতা
স্থানীয় বিদ্যাভূষণপাড়ার কাউছার আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আবদুল ওয়াহেদ একসময় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। রামনাথ বিশ্বাসের বাড়ির দখল ছাড়তে চাপ শুরু হলে স্থানীয় দুজন প্রভাবশালী নেতা ও জনপ্রতিনিধির হাত ধরে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন।’
২ নম্বর বানিয়াচং উত্তর-পশ্চিম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হায়দারুজ্জামান খান ধন মিয়া বলেন, ‘ওয়াহেদ একজন দখলদার। রামনাথ বিশ্বাসের বাড়িটি তিনি দখল করে রেখেছেন। সরকারি খাতায় এটি অর্পিত সম্পত্তি। অনেক চেষ্টা করেও আমরা বাড়িটিকে দখলমুক্ত করতে পারিনি। তিনি (ওয়াহেদ) কিছুদিন পর পরই বাড়িকে নিজের নামে নামজারি করে ফেলেন, কিন্তু আমরা সেটাকে বাতিল করি।’
স্বাধীনতা যুদ্ধে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের গেরিলা দল ‘দাস পার্টির’ অন্যতম সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা হায়দারুজ্জামান খান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আবদুল ওয়াহেদের বড় ভাই আবু ছালেক এই এলাকার আলবদর বাহিনীর সদস্য ছিলেন। বর্তমানে তিনি পলাতক।’
রামনাথ স্মৃতি সংসদের সভাপতি ও লোক গবেষক আবু সালেহ আহমেদ বলেন, ‘দখলদার আবদুল ওয়াহেদ খুবই প্রভাবশালী। এ কারণে এলাকার কেউ বাড়িটি উদ্ধারের বিষয়ে কোনো কথা বলে না। আমি রামনাথের স্মৃতিটুকু বাঁচাতে অনেক চেষ্টা করেছি। সাংস্কৃতিক কর্মী ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে কয়েকবার তার ভুয়া নামজারি বাতিল করেছি। সর্বশেষ ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়েও একবার নামজারি বাতিল করেছি। এটা যে রামনাথের বাড়ি, সে বিষয়ে অনেক কাগজপত্র আমাদের কাছে আছে।’
- আরও পড়ুন: রামনাথের বাড়ি দখলে ওয়াহেদ এখন আ.লীগ নেতা
তিনি বলেন, ‘বছরখানেক আগে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম হাইকোর্টে রিট করব। তবে যারা আমাদের সঙ্গে ছিলেন তাদের আবদুল ওয়াহেদ ভয়ভীতি দেখিয়ে থামিয়ে দেন।’
প্রায়ই আক্রান্ত সাংবাদিক-পর্যটক
বাড়িটি দখলের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে বেশ কয়েকবার হামলার শিকার হয়েছেন সংবাদকর্মীরা। সর্বশেষ হবিগঞ্জের স্থানীয় চারজন সাংবাদিক ৬ সেপ্টেম্বর ওই বাড়িতে গিয়ে হামলার শিকার হন। এর চার দিন পর ১১ সেপ্টেম্বর বিডিনিউজের স্পেশাল অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর রাজীব নূর দখলদারদের হামলার শিকার হয়েছেন। এ সময় স্থানীয় আরও তিনজন সাংবাদিককেও মারপিট করেন আবদুল ওয়াহেদ ও তার ছেলেরা।
বানিয়াচং প্রেস ক্লাব সভাপতি মোশাহেদ মিয়া নিউজবাংলাকে বলেন, ‘রামনাথের বাড়িতে গেলেই সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ করেন ওয়াহেদ মিয়া ও পরিবারের সদস্যরা। বিভিন্ন সময় বাড়িটিকে দেখতে যাওয়া পর্যটকরাও লাঞ্ছিত হয়েছেন।’
তবে হামলার অভিযোগ এবং বাড়ি দখলের অভিযোগ অস্বীকার করছেন আবদুল ওয়াহেদ। এ বিষয়ে প্রশ্ন করতেই তিনি উত্তেজিত কণ্ঠে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এ বাড়ি রামনাথ বিশ্বাসের না। এই এলাকার কেউ এটিকে রামনাথ বিশ্বাসের বাড়ি বলে প্রমাণ করতে পারবে না। সাংবাদিকরা এখানে এসে আমাকে শুধু শুধু বিরক্ত করে। আপনারা আমার বাড়ি থেকে বের হয়ে যান। না হলে খারাপ হবে।’
এ বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা ছিল না। সংবাদমাধ্যমে বিষয়টি জেনেছি। কেউ আমাদের এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ ও আবেদন দিলে বাড়িটির বিষয়ে খোঁজখবর নেব। যেহেতু এটি সরকারি সম্পত্তি নয়, তাই আমরা নিজেরা ওইখানে ইন্টারফেয়ার করতে পারি না।’