ভারত সফর থেকে শূন্য হাতে ফিরেছেন বলে বিএনপির পক্ষ থেকে যে বক্তব্য এসেছে, তা নাকচ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি দেশটির সঙ্গে নানা সমঝোতা ও সহযোগিতার চুক্তির বিষয়টি তুলে ধরে বলেছেন, ‘আমার মনে হয় না আমি শূন্য হাতে ফিরেছি।’
এই সফর নিয়ে বিস্তারিত জানাতে বুধবার গণভবনে করা সংবাদ সম্মেলনে একজন সাংবাদিক সরাসরি প্রশ্ন করেন, ‘ভারত সফর থেকে কী পেলাম?’
জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘প্রশ্নটি আপেক্ষিত, এই প্রশ্নের জবাব নির্ভর করছে আপনি কীভাবে দেখছেন। ভাগ্যিস প্রশ্ন করেননি কী দিলাম।’
ভারত সফরে নানা চুক্তি ও আলোচনা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘এ রকম যদি হিসাব করেন, মনে হয় না একবারে শূন্য হাতে এসেছি বলতে পারেন না। তাছাড়া কী পেলাম, কী পেলাম না এটা তো মনের ব্যাপার।
‘কী পেলাম না পেলাম এটা মনের ব্যাপার। বাংলাদেশে এত কাজ করার পর বিএনপি বলে কিছুই করিনি। এখানে বলার কিছু নেই। এটা মানুষের বিশ্বাসের ব্যাপার, আত্মবিশ্বাসের ব্যাপার।’
ভারত থেকে কম দামে তেল আনতে দেশটির কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত করার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, এতে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে বাঘাবাড়ী হয়ে উত্তরবঙ্গে তেল পাঠাতে হবে না। সরাসরি ভারত থেকে সেখানে তেল গেলে উত্তরবঙ্গের অর্থনীতি আরও বেগবান হবে। এই তেল আনতে পাইপলাইন করে দিচ্ছে ভারত। দিনাজপুরের পার্বতীপুরে ডিপোতে তেল থাকবে।’
ভারত থেকে এলএনজি আমদানির ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী। এই তরল গ্যাস খুলনায় আনতে চায় বাংলাদেশ।
গত ৫ থেকে ৮ সেপ্টেম্ব পর্যন্ত প্রতিবেশী দেশটিতে সফর করেন সরকারপ্রধান। দেশটির সঙ্গে সাতটি সমঝোতা সই হয় এই সফরে।
শেখ হাসিনা বিদেশ সফর করলে বরাবর সে সফর নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসেন। এতে সফরের বিষয়ে একটি লিখিত বিবৃতি দেন। পরে তিনি গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশ্নের উত্তর দেন। সেই প্রশ্নোত্তর পর্বে সাধারণত রাজনৈতিক বিষয়গুলোই প্রাধান্য পায়।
তবে ভারত সফর নিয়ে সংবাদ সম্মেলনগুলো একটু ব্যতিক্রম হয় এই কারণে যে, প্রশ্নগুলো সাধারণত সফর নিয়েই থাকে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত সব সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আওয়ামী লীগবিরোধীরা বরাবর অভিযোগ করে আসছে যে, ক্ষমতাসীনরা ভারতের প্রতি দুর্বল এবং তারা জোরালোভাবে দাবি তুলে ধরতে পারে না।
বিপরীতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়, ভারতের কাছ থেকে যা কিছু আদায় করতে পেরেছে তার সবই করেছে আওয়ামী লীগ। বিরোধীরা কথার মালা ছাড়া কিছুই করতে পারে না।
এর আগে শেখ হাসিনা যতবার ভারত সফর করেছেন, ততবার দেশটির সঙ্গে চুক্তি ও সমঝোতার বিষয়ে খুঁটিনাটি সংবাদ সম্মেলন থেকেই জানা গেছে।
সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে শেখ হাসিনা লিখিত বিবৃতিতে চু্ক্তির বিষয়ে জানান। বিশেষভাবে তুলে ধরেন ভারতের মাটি ব্যবহার করে বাংলাদেশের ট্রানজিট সুবিধা আদায়ের কথা।
সফরে বাংলাদেশ উদারতা দেখেছে কি?
এই সফরে বাংলাদেশ সফরে প্রত্যাশিত উদারতা পেয়েছে কি না- এমন প্রশ্ন ছিল অন্য একজন গণমাধ্যমকর্মীর।
জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘যথেষ্ট আন্তরিকতা আমি পেয়েছি। প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি যাদের সঙ্গেই কথা হয়েছে তাদের আন্তরিকতা ছিল। বাংলাদেশের বিষয়ে ভারতের সব দলমত কিন্তু এক থাকে। স্বাধীনতা যুদ্ধ বা ছিটমহল বিনিময়ের সময়ও সবাই একমত হয়েছিল।’
পাশাপাশি থাকলে নানা সমস্যা থাকতে পারে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কিন্তু আলাপ-আলোচনায় সব সমস্যা সমাধান করা যায়। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাক যুদ্ধের পর অনেক রেললাইন বন্ধ ছিল। এগুলো আমরা একে একে খুলছি।’
অন্য একজন গণমাধ্যমকর্মী বলেন, ‘এই সফরের চুক্তির পর ভারতের গণমাধ্যমে কেউ কেউ লিখেছে, ভারত সরকার তার জাতীয় স্বার্থ বিকিয়ে দিয়েছে।’
জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের এখানে যারা বলছে জাতীয় স্বার্থ বিকিয়ে দিয়েছে, তাদের সঙ্গে তাদের ওখানে যারা বলছে জাতীয় স্বার্থ বিকিয়ে দিয়েছি, তাদের মধ্যে একটা ডিবেট করান। ভালো হবে।’
রোহিঙ্গারা বোঝা হয়ে যাচ্ছে
রোহিঙ্গা সংকটে ভারতের মনোভাব- জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। ভারতও উপলব্ধি করে আমাদের এখানে সমস্যা তৈরি হচ্ছে, প্রকৃতি নষ্ট হচ্ছে। তাদের নিজেদের মধ্যে অস্ত্র, সন্ত্রাস, মাদক চোরাচালানসহ আরও সমস্যা বাড়াচ্ছে।
‘সাড়া পেয়েছি ইতিবাচক। কিন্তু সমস্যা মিয়ানমারকে নিয়ে। যে যত চাপ দিক, তারা ইয়ে করে না। মানবিক কারণে স্থান দিয়েছি, কিন্তু বড় বোঝা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ফেলে তো দিতে পারি না।’
লিখিত বক্তব্যে যা বললেন
প্রশ্নোত্তরের আগে লিখিত বক্তব্যে তার সফরে করা সাতটি সমঝোতার কথা তুলে ধরে বলেন, ‘আমার এ সফর হতে কিছু উল্লেখযোগ্য অর্জন আমি আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চাই:
# কুশিয়ারা নদীর পানি বণ্টনে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর, যার মাধ্যমে ১৫৩ কিউসেক পানি প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত।
# সীমান্তে প্রাণহানির সংখ্যা শূণ্যে নামিয়ে আনতে কাজ করতে দুই দেশ সম্মত হয়েছে ।
# ভুটানের সঙ্গে রেল যোগাযোগ ও অন্যান্য আন্তঃসীমান্ত রেল সংযোগে বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করা হবে।
# চিনি, পেঁয়াজ, আদা, রসুনের মত নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য রপ্তানি বন্ধের আগে বাংলাদেশকে আগাম বার্তা দিতে ভারত সরকার পদক্ষেপ নেবে।
# বাংলাদেশের মুজিবনগর থেকে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত স্বাধীনতা সড়ক চালু করা হবে।
# নদী দূষণ এবং অভিন্ন নদ-নদীর ক্ষেত্রে নদীর পরিবেশ এবং নদীর নাব্যতা উন্নয়নের লক্ষ্যে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া হবে।
# রেলওয়ে সেবার মান বাড়াতে আইটি সল্যুশন বিনিময় করা হবে।
# ২০২২ সালের মধ্যে সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি নিয়ে দুই দেশের বাণিজ্য কর্মকর্তাদের কাজ শুরু করার নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি মনে করি কোভিড মহামারির প্রেক্ষিতে দীর্ঘ তিন বছর বিরতির পর আমার এই সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছে।
‘সফরের পুরো সময় জুড়ে আমরা ভারতের আন্তরিকতার বহিঃপ্রকাশ ও সৎ প্রতিবেশী হিসেবে সমতা ও শ্রদ্ধার ভিত্তিতে দুই দেশের সহযোগিতা অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার লক্ষ্য করেছি ‘
তিনি বলেন, ‘এই সফরে সহযোগিতার যে সকল ক্ষেত্র চিহ্নিত হয়েছে এবং বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে যেসব সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা বাস্তবায়ন করলে উভয় দেশের জনগণ উপকৃত হবে বলে আমি মনে করি।
‘সব মিলিয়ে পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে এ সফরের মাধ্যমে দুই দেশের একসঙ্গে নতুনভাবে এগিয়ে চলার গতি সঞ্চার হয়েছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, উভয় দেশের জনগণের কল্যাণে এই সহযোগিতার ধারা অব্যাহত থাকবে এবং বাংলাদেশ ও ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়া অচিরেই একটি সমৃদ্ধশালী অঞ্চলে পরিণত হবে।’