বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

সবজির চারার গ্রামে ক্রেতাশূন্যতায় হতাশা

  •    
  • ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ১১:৩২

নার্সারি মালিক সংগঠন বলছে, বন্যার শঙ্কায় অনেক কৃষক চারা কিনছেন না। ফলে মাঠে অন্তত ৪ কোটি সবজির চারা বিক্রির অভাবে পড়ে রয়েছে। এটি সময়মতো বিক্রি না করতে পারলে লোকসানের মুখে পড়বেন ব্যবসায়ীরা।

বগুড়ার শাহনগর পরিচিত ‘সবজির চারার গ্রাম’ নামে। শীতের সবজি চাষের আগে এ এলাকার নার্সারিগুলোতে বাড়ে কর্মচাঞ্চল্য। কিন্তু গত বছরের চেয়ে এবার নানা বাধায় পড়তে হচ্ছে সবজির চারা উৎপাদনকারীদের। বিরূপ আবহাওয়া, শ্রমিকের বাড়তি মজুরি ও সার-বীজের বাড়তি দাম নিয়ে দুশ্চিন্তায় তারা।

নার্সারি মালিক সংগঠন বলছে, বন্যার শঙ্কায় অনেক কৃষক চারা কিনছেন না। ফলে মাঠে অন্তত ৪ কোটি সবজির চারা বিক্রির অভাবে পড়ে রয়েছে। এটি সময়মতো বিক্রি না করতে পারলে লোকসানের মুখে পড়বেন ব্যবসায়ীরা।

শাজাহানপুর উপজেলার শাহনগর গ্রাম। ১৯৮৫ সালের দিকে এখানকার বড়পাথার এলাকায় সবজির নার্সারি ব্যবসা শুরু হয়। ভালো আয় হওয়ায় চারা তৈরির নার্সারি ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের খলিশাকান্দী চোপিনগর, খোট্টাপাড়া, দুরুলিয়া, বৃ-কুষ্টিয়াসহ কয়েকটি গ্রামে। কয়েকটি গ্রামজুড়ে গড়ে উঠেছে অন্তত ২৫০টি ছোট-বড় নার্সারি।

এখানে ফুলকপি, বাঁধাকপি, টম্যাটো, বেগুন, পেঁপেসহ মরিচের চারা পাওয়া যায়। তবে মরিচের চারা বিক্রি হয় বেশি। জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত আগাম শীতকালীন সবজির চারা নিতে দেশের বিভিন্ন জেলার ক্রেতার সমাগম হয় শাহনগরে। এতে সেখানে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় দুই হাজার মানুষের।

শাহনগরের প্রবীণ নার্সারি মালিক জালাল উদ্দিন প্রামাণিক। খলিশাকান্দি গ্রামে সাড়ে চার বিঘার ওপর তার নার্সারি। অনেক আগে থেকেই জালাল গাছ নিয়ে শহরে বিক্রি করেন।

এই নার্সারি মালিক বলেন, ‘৪০ বছর আগে আমজাদ হোসেনের হাত ধরে শাহনগরে সবজির চারা উৎপাদনের শুরু। আমি নিজেও তার কাছ থেকে চারা সংগ্রহ করে শহরে বিক্রি করেছি।’

চারা তৈরির বিষয়ে জালাল উদ্দিন জানান, শীতের সবজির জন্য তারা জুলাই থেকে কাজ শুরু করেন, চলে অক্টোবর পর্যন্ত। কিন্তু এবার তাদের ব্যবসায় প্রথম আঘাত হানে খরা। বর্ষার মৌসুমেও বৃষ্টি না হওয়ায় অনেকের সবজির চারা নষ্ট হয়ে গেছে।

এর মধ্যে জালালের প্রায় তিন লাখ পিস সবজির চারা নষ্ট হয়। এতে ক্ষতির পরিমাণ তিন লাখ টাকা। পাশাপাশি বাজারে বীজসহ সারের দামও বেড়েছে। এ ছাড়া গত বছরের চেয়ে এবার প্রতি শ্রমিকের জন্য ব্যয় হচ্ছে বাড়তি তিন হাজার টাকা। ফলে সামগ্রিকভাবে সব নার্সারি মালিকদের চারা তৈরিতে খরচের হিসাব বড় হয়েছে।

জালাল উদ্দিন বলেন, ‘তারপরও আগাম সবজিতে ভালো বিক্রি হয়েছে। কিন্তু এখন বেচাকেনায় ভাটা পড়েছে। মাঠে অনেক সবজির চারা পড়ে আছে। তবে ক্রেতা আসা শুরু করলে আমার ১০ লাখ টাকার চারা বিক্রি সম্ভব।’

নার্সারি মালিকরা জানান, বর্তমান প্রতি হাজার পিস মরিচের চারা বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকায়। ফুলকপির চারা ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা, বাঁধাকপি ৭০০ টাকা এবং বেগুন ও টম্যাটোর চারার দাম ৫০০ টাকা।

মৌসুমের শুরুতে আগাম সবজি হিসেবে মরিচের চারার দাম আরও বেশি ছিল। প্রতি হাজার পিস চারা বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ৪০০ থেকে এক হাজার টাকায়। কিন্তু চারা বিক্রির মূল সময়ে এসে দাম কমেছে। কারণ এখনকার সবচেয়ে বড় ক্রেতা জামালপুরের কৃষকরা। বন্যার কারণে তারা চারা কিনছেন না। এতে সবজির চারা গ্রামে দেখা দিয়েছে ক্রেতার সংকট।

নার্সারি মালিক সূত্র আরও জানায়, বগুড়ার পশ্চিম অঞ্চল নন্দীগ্রাম, কাহালু, দুপচাঁচিয়া, আদমদীঘি থেকে আগাম জাতের সবজির চারা বেশি কেনা হয়। শীতকালীন সবজির চারা নিয়ে যান যমুনা নদীর এলাকার কৃষকরা।

ক্রেতা সংকটের কারণ জানান এখানকার আরেক ব্যবসায়ী মাসুদ রানা। তিনি এই মৌসুমে প্রায় ৪০ লাখ পিস চারা বিক্রি করেছেন। এতে তার আয় অন্তত ২৫ লাখ টাকা।

মাসুদ বলেন, ‘নদীতে পানি বাড়ছে। এ সময় কৃষকরা ঝুঁকি নিতে চাইছেন না। বগুড়ার অল্প কিছু কৃষক আসছেন, কিন্তু বাইরের জেলার ক্রেতাদের আনাগোনা নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের এলাকায় আগাম সবজির চারা দৈনিক প্রায় ১০ লাখ পিস বিক্রি হয়েছে। আর এখন ক্রেতার দেখাই পাওয়া যাচ্ছে না। যাদের এলাকায় পানি ওঠার শঙ্কা নেই, তারাই টুকটাক চারা কিনছেন।’

সবজির চারা কিনতে এসেছেন বগুড়ার সারিয়াকান্দির চালুয়াবাড়ীর এজাজুল ইসলাম। জানালেন, তিনজন মিলে বিজলী ও সতেরো শ জাতের ৬০ হাজার মরিচের চারা কিনেছেন। প্রতি হাজারের দাম ৩০০ টাকা।

জামালপুরের মাদারগঞ্জের কৃষক আবু বক্কর বলেন, ‘আমরা প্রতি বছর এখান থেকে মরিচের চারা নিয়ে যাই। জামালপুরের আরও অনেক কৃষক চারা কেনেন। কিন্তু এখন যমুনা নদীতে পানি বাড়ছে। এজন্য এখন চারা কেনার ঝুঁকি নিচ্ছি না। পানি না কমলে অন্য কৃষকরাও আসবেন না।’

ব্যবসার পরিস্থিতি নিয়ে জানান শাহনগর সবজির চারা নার্সারি মালিক সংগঠনের সভাপতি আমজাদ হোসেন। তিনি জানান, এবার নার্সারি মালিকরা সবচেয়ে বেশি ধাক্কা খেয়েছেন বীজ সংগ্রহে। ভারতে আবহাওয়া খারাপ হওয়ায় মরিচের বীজের উৎপাদন ভালো হয়নি। এজন্য দাম বেড়েছে। বিজলী জাতের মরিচের বীজের দাম ছিল প্রতি কেজি ৪৮ হাজার টাকা। এবার সেটি নিতে হয়েছে ৭২ হাজার টাকায়। সতেরশ জাতের মরিচের বীজের দাম ছিল প্রতি কেজি ২৮ হাজার টাকা। সেটি কিনতে হয়েছে ৩১ হাজার টাকা। এভাবে সব জাতের বীজের দাম গড়ে ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা বেড়েছে।

আমজাদ হোসেন বলেন, ‘খরচ বাড়লেও আগাম সবজির চারা তৈরিতে নার্সারি মালিকরা বেশ খুশি ছিলেন। কারণ ক্রেতা ছিল প্রচুর। ওই সময় এখানকার নার্সারি মালিকরা অন্তত ৫ কোটি টাকা আয় করেছেন। কিন্তু মূল শীতের সবজিতে এসে আমরা ধরা খেয়েছি। প্রায় ২৫০ নার্সারির অন্তত ৪ কোটি সবজির চারা পড়ে আছে। এখন দৈনিক এক লাখ টাকার নিচে বিক্রি হচ্ছে। তাও অল্প কয়েকটি নার্সারিতে।

‘ব্যবসার এ সংকট আবহাওয়ার ওপর নির্ভরশীল। এখানে আমাদের কোনো হাত নেই।’

তবে এখনই বন্যার শঙ্কা কেটে গেলে আবার আগের মতো বেচাকেনা শুরু হয়ে যাবে বলে জানান এই নার্সারি মালিক নেতা।

শীতকালীন সবজির চাষ নিয়ে বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপসহকারী কর্মকর্তা ফরিদুর রহমান জানান, জেলায় এ বছর প্রায় সাড়ে তিন হাজার হেক্টর জমিতে আগাম সবজির চাষ হয়েছে। গত বছর একই পরিমাণ জমিতে প্রায় ৫৪ হাজার টন ফসল উৎপাদন হয়। এ ছাড়া গতবার শীতকালীন সবজি আবাদ হয়েছিল প্রায় ১৪ হাজার হেক্টর জমিতে। এবার সেই সাপেক্ষে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করবে জেলা কৃষি দপ্তর।

শাজাহানপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. নুরে আলম বলেন, ‘শাহনগরের সবজির চারা দেশজুড়ে খ্যাতি রয়েছে। উত্তরবঙ্গসহ দেশের অন্তত ২৬টি জেলায় সরবরাহ হয়। আবহাওয়ার পরিস্থিতির কারণে এবার সাময়িক সংকট থাকতে পারে। তবে তা দ্রুত কাটিয়ে উঠবে। শাহনগরের এই সবজির চারাকে ঘিরে বছরে অন্তত ১০ কোটি টাকা আয় করেন নার্সারি সংশ্লিষ্টরা।’

এ বিভাগের আরো খবর