রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগে অক্সিজেন সরবরাহ না করা, অক্সিজেন ফিল্টার না থাকা ও ডিউটিরত নার্স এবং চিকিৎসকের অবহেলায় ফিরোজ রওশন আলম নামে এক রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ তুলেছেন তার ছেলে।
হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের সিসিইউ (করনারি কেয়ার ইউনিট) ওয়ার্ডে সোমবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে তিনি মারা যান। তার বাড়ি গাইবান্ধা জেলার সদর উপজেলার পশ্চিম পেয়ারা পাড়া গ্রামে।
ফিরোজের ছেলে সোয়াত রাব্বানি সোমবার মধ্যরাতে হাসপাতালেই বাবার লাশ নিয়ে ফেসবুকে লাইভে এসে হাসপাতালের বিরুদ্ধে অব্যবস্থাপনা ও চিকিৎসক-নার্সের অবহেলার অভিযোগ তোলেন।
সব অভিযোগ অস্বীকার করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তারা বলছেন, সেই রোগী ছাড়পত্র নিয়েছিলেন। তার ঢাকায় যাওয়ার কথা ছিল। এরপরও তিনি হাসপাতালে সে রাতে ছিলেন। অসুস্থ বোধ করার পর সব ধরনের চেষ্টা করা হয়েছে। তবে তাকে বাঁচানো যায়নি।
হাসপাতালগুলোতে অব্যবস্থাপনা আর রোগীর প্রতি অবহেলার অভিযোগ ওঠে প্রায়ই। এ কারণে এই লাইভ করার পর ফেসবুকে তা ভাইরাল হয়ে যায়। লাইভের কমেন্টে লোকজন হাসপাতাল ও চিকিৎসকের শাস্তির দাবি জানায়।
ফেসবুক লাইভে কী অভিযোগ
ফিরোজের ছেলে সোয়াত ফেসবুক লাইভে বলেন, ‘ওরা আমার বাবাকে খুন করছে।
‘বাবা যখন অসুস্থ হয়ে ছটফট করতেছিলেন তখন কোনো নার্স ও ডাক্তার বাবার পাশে ছিলেন না। আমি তখন আমার বোনের বাসায় ছিলাম। বাবার পাশের একজন রোগী আমার বোনকে ফোন করলে আমি অন্য একজনের মোটরসাইকেলে চলে আসি।’
সোয়াত বলেন, “এসে দেখি বাবা ছটফট করতেছে, আর বলতেছিল, ‘আমি আর বাঁচব না’। এরপর আমি ডক্টরের কাছে গেছি। ডক্টর আসছিলেন কিন্তু আশপাশে কোনো অক্সিজেন ছিল না। অক্সিজেনের স্টকে ছিল কিন্তু ফিল্টার ছিল না।”
সোয়াত অভিযোগ করেন, ‘দুইজন ডক্টর এসে অক্সিজেন নিতে হবে বলে জানান। কিন্তু অক্সিজেন বেড নাই। হুইল চেয়ার আনতে গেছি, সেটাও নাই। শেষে আমি কোলে নিয়েছি। কোলে করে সিসিউতে নেই। সেখানে নার্সরা জানায়, অক্সিজেনের পাইপ লাগবে। পাইপ কেনা ছিল সেটা দিতে দিতে আব্বুর মুখ থেকে ফেনা বের হয়ে গিয়েছিল। শেষে অক্সিজেন দিয়ে বলেছিল, ৪৫ হাজার টাকার ইনজেকশন দিতে হবে। আমি বলেছি যা করার আমি করব। পরে আব্বু মারা গেছে।’
অন্য রোগী, প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য মেলে না
এই অভিযোগের বিষয়ে জানতে রওশন আলম যে কক্ষে মারা গেছেন, তার পাশের রোগীদের সঙ্গে কথা বলেছে নিউজবাংলা। তবে সেই ছেলের অভিযোগের পক্ষে বলেননি তারা।
ওই ওয়ার্ডের অন্য রোগীর স্বজনরা জানান, মৃত্যুর আগে ফিরোজ ওয়ার্ডের বাইরে গিয়ে অতিরিক্ত ধুমপান করেছিলেন। কিছুক্ষণ পর অসুস্থ হয়ে পড়েন।
ওই ওয়ার্ডের ১৭ নম্বর বেডের রোগীর স্বজন মো. ফিরোজ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘উনি যখন রাতে মারা যান তখন অক্সিজেনের ফিল্টার ছিল না, এটা ঠিক। কিন্তু উনি সুস্থ ছিলেন।
‘রাত ১১টার পরে বার বার তার স্ত্রীকে বলেছেন যে সিগারেট খাবেন। কিন্তু তার স্ত্রীর তাকে বাধা দিয়েছে সিগারেট না খেতে। ডাক্তার এবং তার ছেলেও বারণ করেছেন। এরপরেও তিনি ওয়ার্ডের বাইরে গিয়ে অনেকক্ষণ সিগারেট খেয়েছেন। এর কিছুক্ষণ পরেই এই দুর্ঘটনা ঘটে। পরে তার ছেলে এসে তো লাইভ করল।’
ফিরোজ বলেন, ‘এই ওয়ার্ডে অক্সিজেনের সেন্ট্রাল লাইন। অক্সিজেনের কোনো সমস্যা নাই।’
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কী বলছে
সেদিন সকালে হৃদরোগ বিভাগে নার্সের দায়িত্বে ছিলেন শহিদুল ইসলাম। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ফিরোজ হৃদরোগ বিভাগে ভর্তি হন ১০ সেপ্টেম্বর। তার ট্রিটমেন্ট চলছিল ১৬ নম্বর বেডে। তিনি সোমবার অনেকটাই সুস্থ বোধ করছিলেন।
‘সোমবার সকালের রাউন্ডে হৃদরোগ বিভাগের প্রধান হরিপদ সরকার, রবীন্দ্রনাথ সেন, মাহবুবুর রহমানসহ অনেক স্যারই রাউন্ড দিয়েছেন। ওই সময় রোগীর অবস্থা ভালো দেখে স্বজনদের স্যাররা বলেছিলেন, তারা ছাড়পত্র নিবেন কি না। তখন রোগীর স্বজনরা জানান, তারা ছাড়পত্র নিয়ে ঢাকায় যাবেন। এজন্য সব প্রস্তুত করা হয়।’
শহিদুল বলেন, ‘ওই ব্যক্তির ছেলে (লাইভ করা ব্যক্তি) এখন নিচ্ছে, একটু পর নিচ্ছে করতে করতে বিকাল ৩টার দিকে ছাড়পত্র রেডি করে নেয়। কিন্তু এরপর আমার কাছেই রেখে দিয়ে বলে, আপনার কাছে ছাড়পত্র থাক, আমি যখন যাব তখন নেব। সেই অনুযায়ী ছাড়পত্রটি আমার কাছেই রাখি।’
তিনি আরও বলেন, ‘ছাড়পত্র দেয়ার পর নিয়ম অনুযায়ী কোনো রোগী বেডে থাকবে না, ওষুধ পাবে না। কিন্তু তারপরেও আমরা রেখেছি। কারণ, তাদের আজ (মঙ্গলবার) ঢাকায় যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কখন যাবে সেটা আমাদের বলেনি। শুধু বলেছে যাব। এটা তো গুরুত্বপূর্ণ ওয়ার্ড। বেড ফাঁকা না থাকায় আরেক গুরুতর অসুস্থ রোগী আসতে পারে না।’
ছাড়পত্র দেখতে চাইলে তিনি জানান, ফিরোজের স্বজনরা সেটি নিয়ে গেছেন। তবে হাসপাতালের রেজিস্ট্রি খাতা এনে ফিরোজের ডিসচার্জের তথ্য দেখান তিনি। সেখানে সোমবার ডিসচার্জের সময় লেখা দেখা গেছে।
ওই ওয়ার্ডের এক নার্স নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘আমি বিকালের শিফটে ছিলাম। যখন ওই রোগীকে ওষুধ দিতে গিয়েছি তখন তিনি ওষুধ নেননি। বলেছেন, তিনি ছাড়পত্র নিয়েছেন, কাল চলে যাবেন। এরপর আমরা আর মেডিসিন দেইনি।
‘তিনি পুরোপুরি সুস্থ হওয়ায় তার বেডে যে অক্সিজেন ফিল্টার ছিল সেটি অন্য রোগীকে দেয়া হয়েছে। তিনি ওয়ার্ডে হাঁটাহাটি করছিলেন, খাবার খাচ্ছিলেন, অন্য রোগীর সঙ্গে হাসাহাসিও করছিলেন। রাতে হঠাৎ শুনি তিনি ওয়ার্ডের বাইরে গিয়ে পরপর কয়েকটা সিগারেট খেয়ে বেডে এসে পড়ে গেছেন।’
সোহেলা পারভীন শিল্পী নামে আরেক নার্সও ওই ওয়ার্ডে ছিলেন ঘটনার সময়।
নিউজবাংলাকে তিনি জানান, সে সময় সেখানে ৭ জন চিকিৎসক এবং তিনিসহ ৩ জন নার্স ছিলেন। ফিরোজের অসুস্থতা বোধ করার তথ্য জানার সঙ্গে সঙ্গে তারা ট্রলি নিয়ে যাচ্ছিলেন। ততক্ষণে ফিরোজকে কোলে তুলে নিয়ে বের হয়ে গেছিলেন তার ছেলে সোয়াত। এরপর ট্রলিতে করেই ফিরোজকে সিসিইউতে নিয়ে অক্সিজেন দেয়া হয়। প্রয়োজনী সব চিকিৎসা দেয়া হয়। তবে তাকে বাঁচানো যায়নি।
সুস্থ হয়ে ছাড়পত্র নেয়া রোগী হঠাৎ কেন অসুস্থ হয়ে পড়লেন? জানতে চাইলে সোহেলা জানান, হৃদরোগের চিকিৎসা নেয়ার পরপরই ধুমপান করা ঝুঁকিপূর্ণ। ফিরোজের স্ত্রী ও স্বজনরা তাকে ধুমপান করতে বাধা দিয়েছিলেন। তবে রাতে তিনি ওয়ার্ড থেকে বের হয়ে গিয়ে ধুমপান করেছিলেন। এতে হঠাৎ করে তিনি অসুস্থ হয়ে গিয়ে থাকতে পারেন।
ওই ওয়ার্ডে সে সময় ডিউটিতে থাকা চিকিৎসক মো. রোকন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘উনি অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পর আমরা সর্বোচ্চ ট্রিটমেন্ট দিয়েছি। কোনো অবহেলা ছিল না।’
হাসপাতালের উপ-পরিচালক আব্দুল মোকাদ্দেম বলেন, ‘কেউ মারা গেলেই একটা কমন অভিযোগ তোলা হয়। আসলে সেটা ঠিক না।
‘ওই ওয়ার্ড স্পর্শকাতর। সেখানে দিনের বেলায় ৬ জন নার্স সার্বক্ষণিক থাকেন। এছাড়াও ইন্টার্ন থাকেন কমপক্ষে ১৫ জন। রাতের বেলায় থাকেন ৩ জন। সুতরাং তার অভিযোগ সত্য নয়। আমাদের চিকিৎসক নার্সরা সব সময়ই এ বিষয়ে সচেতন থাকেন।’
এসব বিষয়ে জানতে রেজিস্ট্রি খাতা থেকে নেয়া ফিরোজের স্ত্রীর ফোন নাম্বারে একাধিকবার কল করা হয়। তিনি ফোন রিসিভ করেননি। ফিরোজের ছেলে সোয়াতের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ম্যাসেজ দেয়া হলেও সাড়া মেলেনি। অবশ্য সোয়াতের ফেসবুকে দেয়া আপডেট থেকে জানা গেছে, ফিরোজের জানাজা ও দাফনে ব্যস্ত আছে পরিবারটি।