রাজধানীতে বাসে প্রতি দিন সাড়ে আট কোটি টাকা অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হয় বলে দাবি করেছে যাত্রী অধিকার নিয়ে সোচ্চার সংগঠন যাত্রীকল্যাণ সমিতি।
একই সঙ্গে সিএনজি অটোরিকশায় সোয়া পাঁচ কোটি আর হিউম্যান হলারে সাড়ে ছয় কোটি টাকার মতো বাড়তি আদায় করা হয়। অ্যাপের গাড়িও এখন নির্ধারিত ভাড়ায় চলে না। যাত্রী পিছু বাড়তি আদায় হয় ৭৫ টাকা।
সংস্থাটি জানাচ্ছে, কোনো যানবাহনেই সরকারনির্ধারিত ভাড়া আদায় হয় না। আর অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নিয়ে তর্কের জেরে বাসগুলোতে ২৫ টি যাত্রী নিগ্রহের ঘটনা ঘটেছে। বাস থেকে ফেলে ১৪ যাত্রীকে হত্যা করা হয়েছে। গুরুতর আহত হয়েছে ১০ জন যাত্রী।
মঙ্গলবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ চাই’ বিষয়ে এক আলোচনায় এসব তথ্য জানান সংগঠনটির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী।
বাস আর অটোরিকশা ভাড়ায় অনিয়মের বিষয়টি যেমন নতুন নয়, তেমনি অনিয়ম ঠেকাতে সড়ক পরিবহন নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে জরিমানার অকার্যকর পদ্ধতির ব্যবহারও নতুন নয়। একইভাবে নতুন নয় সড়ক মন্ত্রীর হুঁশিয়ারি।
এই অনিয়মে যুক্ত হয়েছে রাইড শেয়ারিং বাহনগুলো, যেগুলো অ্যাপের মাধ্যমে নির্ধারিত ভাড়ায় চলার কথা। কিন্তু সেগুলোও এখন চলছে চুক্তিতে, অতিরিক্ত ভাড়ায়।
বেসরকারি বাস তো বটেই, সরকারি সংস্থা রাজউক পরিচালিত চক্রাকার বাসে সরকার নির্ধারিত হারের তিন গুণেরও বেশি ভাড়া আদায়ে বিআরটিএর চোখ বুজে থাকায় ক্ষুব্ধ যাত্রীরা বলছেন, তাদের করের টাকায় একটি অপদার্থ সংস্থা পালা হচ্ছে।
জাতীয় প্রেসক্লাবে যাত্রীকল্যাণ সমিতির আলোচনায় বক্তারা
গত ৫ আগস্ট থেকে ডিজেলের দর লিটারে ৩৪ টাকা বাড়ানোর পর ঢাকায় বাসভাড়া ঠিক করা হয় কিলোমিটারপ্রতি আড়াই টাকা। এই টাকায় সর্বনিম্ন চার কিলোমিটার যাওয়ার কথা। কিন্তু এই চার কিলোমিটারের মধ্যে দুটি ওয়েবিলের চেক বসিয়ে আগে থেকেই সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা করে ২০ টাকা আদায় করা হচ্ছিল। ভাড়া বাড়ার পর তা ১৫ করে ৩০ টাকা আদায়ের চেষ্টা করা হয়। যাত্রীদের প্রতিরোধের মুখে অনেক ক্ষেত্রে অবশ্য স্বল্প দূরত্বে এটা পারেনি শ্রমিকরা।
কিন্তু কোন পথের দূরত্ব কতটুকু, সেটি উল্লেখ করে যে চার্ট থাকার কথা, তা দেখা যাচ্ছে না বাসে, কোনো বাস কোনো চেকে সর্বনিম্ন ভাড়া ২৫ টাকাও রাখছে, যা যাত্রী দুই কিলোমিটার যাক আর ছয় কিলোমিটার যাক।
২৯ আগস্ট তেলের দর লিটারে ৫ টাকা কমানোর দুই দিন পর রাজধানীতে প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া ঠিক করে দেয়া হয় ২ টাকা ৪৫ পয়সা। এই হিসাবে কমার কারণে রাজধানীতে বাসভাড়ায় কোনো প্রভাব এ কারণে পড়েনি যে, এক টাকা ভাড়া কমেছে ২০ কিলোমিটারে। কিন্তু রাজধানীতে ২০ কিলোমিটার গন্তব্যে বাসের রুট নেই বললেই চলে। থাকলেও এত দূরের যাত্রী থাকে না বললেই চলে। তারা চলে ছোট গন্তব্যে।
দুইবারই বাসভাড়া নির্ধারণের পর বিআরটিএর পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে কঠোর হুঁশিয়ারি। বলা হয়েছে, বাড়তি ভাড়া আদায় করা যাবে না। কিন্তু এসব হুঁশিয়ারির পরোয়াই করে না বাসগুলো।
নির্ধারিত বাস ভাড়ার বাড়তি আদায়ে ওয়েবিল নামে যে কৌশল ব্যবহার করা হয়, সেটি বন্ধ করতে পারেনি বিআরটিএ
আর অটোরিকশা মিটারে চলাচল কখনও নিশ্চিত করতে পারেনি বিআরটিএ। আড়াই কিলোমিটার সড়কের জন্য দেড় থেকে দুই শ টাকাও আদায় করা হয়।
প্রতিদিন বাহনগুলো মোট কত টাকা অবৈধ আদায় করে, সে পরিসংখ্যান জানিয়ে মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘রাজধানীর ৫ হাজার বাস-মিনিবাসে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫০ লাখ ট্রিপ যাত্রীর যাতায়াত হয়। এসব বাস-মিনিবাসে যাতায়াতে যাত্রী প্রতি মাথাপিছু গড়ে ১৭ টাকা পর্যন্ত বাড়তি ভাড়া দিতে হয়। এতে ৫০ লাখ ট্রিপ যাত্রী দৈনিক গড়ে সাড়ে ৮ কোটি টাকা বাড়তি ভাড়া পরিশোধ করতে বাধ্য হচ্ছে।’
বাসের পাশাপাশি অন্য যানবাহনেও অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হয় বলেও জানানো হয়। এতে বলা হয়, ১৫ হাজার বৈধ অটোরিকশার পাশাপাশি আরো ১৫ হাজার ঢাকা ও আশেপাশের জেলায় নিবন্ধিত অটোরিকশা অবৈধভাবে চলাচল করে।
‘৩০ হাজার অটোরিকশা দৈনিক গড়ে ১২ ট্রিপ হিসেবে ৩ লাখ ৬০ হাজার ট্রিপ যাত্রী বহন করে। এসব অটোরিকশায় প্রতিট্রিপে গড়ে ১৪৫ টাকা বাড়তি ভাড়া আদায় হয়। এতে দৈনিক ৩ লাখ ৬০ হাজার ট্রিপ যাত্রীকে অটোরিকশা খাতে কেবল বাড়তি ভাড়া দিতে হচ্ছে ৫ কোটি ২২ লাখ টাকা।’
বাসের পাশাপাশি বাড়তি ভাড়া আদায় করা হয় অটোরিকশায়। কখনও মিটারে চালাতে বাধ্য করা যায়নি এই বাহনকে
মোজাম্মেল বলেন, ‘হিউম্যান হলারের ভাড়া নির্ধারণের আইন থাকলেও সরকার ভাড়া নির্ধারণ না করায় এখানে বরাবরই দ্বিগুণ-তিনগুণ বাড়তি ভাড়ায় যাতায়াত করতে হচ্ছে নিন্ম আয়ের যাত্রীদেকে।
‘১২ হাজার বৈধ হিউম্যান হলারের পাশাপাশি মেয়াদোত্তীর্ণ, লক্কড়-ঝক্কড়, স্থানীয় গ্যারেজে তৈরি আরও প্রায় ১৮ হাজার হিউম্যান হলারসহ ৪০ হাজার হিউম্যান হলার রাজধানীতে দৈনিক গড়ে ৮০ লাখ ট্রিপ যাত্রী বহন করে। প্রতিট্রিপে যাত্রীপ্রতি গড়ে ৮ টাকা পর্যন্ত বাড়তি ভাড়া দিতে বাধ্য হয়। এতে ৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা কেবল হিউম্যান হলারের যাত্রীদের বাড়তি ভাড়া গুণতে হচ্ছে।
রাইডশেয়ারিং মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার, ট্যাক্সিক্যাবে যাত্রীপ্রতি গড়ে ৭৫ টাকা পর্যন্ত বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে বলে জানান মোজাম্মেল।
যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব বলেন, ‘ভাড়া নৈরাজ্যের কারণে সামাজিক অস্থিরতা বেড়েছে, পণ্যমূল্য বেড়েছে, সামাজিক অপরাধ বাড়ছে।’
তিনি বলেন, মালিকের দৈনিক জমা, জ্বালানির উচ্চ মূল্য, সড়কের চাঁদাবাজি, গাড়ির মেরামত খরচ ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে এই ভাড়া নৈরাজ্য।