রাজধানীতে যানজট কোনো নতুন ঘটনা নয়। কিন্তু কোনো কোনো দিন পরিস্থিতি ছাড়িয়ে যায় সহ্যের সীমাকে, যেটি দেখা গেল মঙ্গলবার।
এক কিলোমিটার যেতে দেড় ঘণ্টা, দুই কিলোমিটার যেতে দুই ঘণ্টা- এমন অভিজ্ঞতা হচ্ছে নগরবাসীর। যানজট দেখে সড়ক পাল্টে চলতে হয়েছে। কাউকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়া হয়েছে, কেউ কেউ নিজেই হেঁটে যেতে বাধ্য হয়েছেন গন্তব্যস্থলে।
এটি কোনো একক সড়কের চিত্র নয়। প্রায় সব কটি প্রধান সড়কই স্থবির হয়ে আছে সকাল থেকে।
মোশাররফ হোসেন নামের একজন ফেসবুকে রসিকতা অথবা আক্ষেপ করে লিখেছেন, ‘এক ঘণ্টা ২০ মিনিটে বিজয় সরণি থেকে বিজয় সরণি আসলাম।’
অর্থাৎ এক কিলোমিটারেরও কম রাস্তা পাড়ি দিতে লেগেছে এই দীর্ঘ সময়।
রাজধানীজুড়ে যানজটের যে দুঃসহ পরিস্থিতি, তা ফুটে উটেছে মোশাররফের কথায়।
এদিন সকাল থেকেই উত্তরা, মোহাম্মদপুর, ফার্মগেট, তেজগাঁও রামপুরাসহ প্রধান প্রধান সড়কে গাড়ির এমন অস্বাভাবিক প্যাঁচ লেগে যায়, যার কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া কঠিন।
ঢাকায় একটি কর্মশালায় যোগ দিতে রাজশাহী থেকে হাওয়াই জাহাজে করে এসে ভুগেছেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সাজ্জাদ সবুজ।
রাজধানীর কুর্মিটোলায় বনানী ফ্লাইওভারে যানজটে গাড়ির সারি। ছবি: ফেসবুক
তার ফ্লাইট বিমানবন্দরে অবতরণ করে বেলা ১১টা ১০ মিনিটে। সেখান থেকে বের হয়ে উবারে গাড়িভাড়া করার পর লেগে যায় আরও মিনিট তিরিশেক। যাবেন ফার্মগেট।
বেলা দেড়টায় নিউজবাংলাকে তিনি জানান, তখনও গাড়ি হোটেল র্যাডিসন ব্লুর সামনে। অর্থাৎ পৌনে দুই ঘণ্টায় তিনি পাড়ি দিয়েছেন কেবল পাঁচ কিলোমিটার। তখনও তার পথের বাকি ৯ দশমিক ৩ কিলোমিটার।
এরই মধ্যে একজনের সঙ্গে দেখা করার পরিকল্পনা বাদ দিতে হয়েছে বকুলকে। এখন বিকেলে ইউনিসেফের মিটিং ধরা নিয়ে দুশ্চিন্তা পেয়ে বসেছে তার।
বকুল পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই। চাকরি জীবনের প্রথম কয়েক বছর কাটিয়েছেন রাজধানীতেই। ফলে এখানকার সড়কের পরিস্থিতি তার অজানা নয়। কিন্তু তিনি বুঝতেও পারছেন না, এত যানজট কেন।
তার মানে, ঢাকায় এত যানজট কখনও দেখেননি?
বকুল বলেন, ‘না, না, না, না। এত জ্যাম কেন, বুঝতে পারলাম না। গত সপ্তাহেও তো এসেছি। বিমানবন্দর থেকে এক ঘণ্টাতেই পৌঁছে গিয়েছি। আজকে খুবই অস্বাভাবিক, গাড়ি একেবারে নড়ছেই না।’
একই পথ ধরে বাসে করে আসতে গিয়ে ভুগেছেন সংবাদকর্মী হাফসা হোসেন। তার বাসা উত্তরার জসিমউদ্দীন রোডের কাছে। কাজ করেন চ্যানেল আইয়ে।
তিনি বাসে ওঠেন সকাল সাড়ে ১০টায়। তিন ঘণ্টা পর দেড়টা পার হওয়ার পর অবস্থান ছিল মহাখালীর আমতলীর কাছে। অফিস তেজগাঁওয়ের নাবিস্কোতে।
হাফসা জানান, এমনিতে বাসে করে বাসা থেকে অফিসে আসতে এক ঘণ্টা, কখনও দেড় ঘণ্টা লাগে তার। বলেন, ‘আজ যে ভয়াবহ অবস্থা, তা কখনও হয়নি।’
হাফসার শিফট ছিল সকাল ১১টা থেকে। তাতে যোগ দেয়া হয়নি।
ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক (উত্তরা) বিভাগের উপকমিশনার নাবিদ কামাল শৈবাল নিউজবাংলাকে জানান, গাজীপুরে মুন্নু গেট থেকে মিল গেট এলাকা পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তা ভাঙা। তার মধ্যে পানি জমে যাওয়ায় গাড়ি পাস হচ্ছিল না। যে কারণে যানজট হয়েছে, সেটার জের রাজধানীতে ছড়িয়েছে।
কিন্তু এই পথ যদি যানজটের কারণ হবে, তাহলে উত্তরা থেকে মহাখালীগামী গাড়ি কেন এভাবে স্থির হয়ে বসে থাকবে, তার কোনো ব্যাখ্যা তার কাছ থেকে পাওয়া গেল না।
গাজীপুর মহানগর পুলিশের ফেসবুক পেজের ট্রাফিক বুলেটিনে বলা হয়, ‘ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়কের মিলগেট এলাকায় ফ্লাইওভার এর পিয়ার ক্যাপ এর জন্য খুঁড়ে রাখা উন্মুক্ত গর্ত, গর্তের চারপাশে টিন দিয়ে ঘেরাও করে রাস্তা সংকুচিত হওয়া এবং খানাখন্দগুলো দীর্ঘ মেয়াদে মেরামত না করার কারণে উভয়মুখী এক লেনে গাড়ি চলাচল করছে।
‘অবকাঠামোগত এ দুর্বলতার কারণে মহাসড়কটির এ অংশে উভয়মুখী রাস্তায় যান চলাচল নিরবচ্ছিন্ন রাখার প্রয়াসে প্রতিনিয়ত অতিরিক্ত ট্রাফিক সদস্য মোতায়েন করা হয়। কিন্তু জিএমপি এরিয়ার অন্যান্য এলাকায় যান চলাচল স্বাভাবিক রাখতে সক্ষম হলেও ডিএমপিসহ টঙ্গী-মিলগেট এলাকায় বিআরটি প্রজেক্টের অবকাঠামোগত দুর্বলতার কারণে মানুষজনের দুর্ভোগ চরমে উঠেছে।
‘এর সঙ্গে গত রাত থেকে ভারি বর্ষণ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। জনগণের দুর্ভোগ লাঘবে ট্রাফিক বিভাগ বিআরটি প্রকল্পের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে কাজ করে যাচ্ছে। আপনাদের সবার সহযোগিতা একান্ত কাম্য।’
ডিএমপির ট্রাফিক পুলিশের রমনা জোনের সিনিয়র সহকারী কমিশনার রেফাতুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘গাজীপুরের প্রভাব পুরো শহরে পড়েছে। আর রাত থেকে বৃষ্টির কারণে রমনার বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। যে কারণে সকাল থেকে যানজট লেগে আছে।’
তবে দুপুরের পর গাজীপুরের পরিস্থিতির অনেকটা উন্নতি হয়। যে কারণে সেই পথে যান চলাচল স্বাভাবিক হতে শুরু করে। কিন্তু রাজধানীতে এর প্রভাব থেকেই যায়।
ডিএমপির ট্রাফিক পুলিশের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে বলেন, ‘পুলিশ স্টাফ কলেজ বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনায় ১২ থেকে ১৪ সেপ্টেম্বর একটি সম্মেলন হচ্ছে। অতিথিরা হোটেল সোনারগাঁওয়ে অবস্থান করছেন। তাদের কয়েকটি বাস চলাচল করেছে, খুব কম সময়ের মধ্যে। এর পাশাপাশি রাত থেকে শুরু হওয়া বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতা যানজটের অন্যতম প্রধান কারণ।’
আরেক সংবাদকর্মী জান্নাতুল ফেরদাউস তানভীর বাসা মিরপুরের পল্লবীতে। কর্মস্থল তেজগাঁওয়ে। সিএনজি অটোরিকশায় ওঠার পর গন্তব্যে যেতে পারেননি। তীব্র যানজট দেখে চালক তাকে নামিয়ে দেন ইসিবি চত্বরে। পরে ওঠেন বাসে। সেখান থেকে নামেন আমতলী সেতু ভবনে। এরপর বাস থেকে নেমে মহাখালী মোড় পার হয়ে রিকশায় করে যান তেজগাঁওয়ে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন কার্যালয়ে। সব মিলিয়ে সাড়ে চার ঘণ্টা লেগেছে।
নিউজবাংলাকে তানভীর বলেন, ‘এর আগে তিন ঘণ্টা লেগেছে, এমন অভিজ্ঞতা ছিল। কিন্তু সাড়ে চার ঘণ্টা লাগেনি কখনও। মেজাজ ভীষণ খারাপ।
নগরীর দক্ষিণ অংশে মোহাম্মদপুরের আদাবরে থাকেন আল হেলাল শুভ। তারও কর্মস্থল তেজগাঁওয়ে। তিনি নিজেই বাস থেকে নেমে পড়েছেন যানজট দেখে।
আগারগাঁওয়ে আসার পর যখন দেখেন গাড়ি আর আগাচ্ছে না, তখন নেমে নিলেন বাইক।
শুভ বলেন, ‘আগারগাঁও পর্যন্ত বাসে। দেখি পুরো রাস্তা জ্যাম। বাস থেকে নেমে পরে নিলাম বাইক। সেই বাইক প্রথমে লিংক রোড ধরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হয়ে আসতে চাইল। কিন্তু একটু এগিয়ে চালক দেখেন, পুরো রাস্তা ব্লক। এ দেখে আবার বাইক ঘুরিয়ে বিজয় সরণির দিকে যান। বিজয় সরণিও পুরো ব্লক দেখে পরে যান ফার্মগেট হয়ে। এরপর সাত রাস্তা হয়ে হাতিরঝিল দিয়ে এসেছি অফিসে।’