বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

‘পুলিশের গুলিতে’ অঙ্গহানি: কবে যাবে তদন্তের আদেশ

  •    
  • ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ১০:৩৬

২০২১ সালের ১৬ জুন পুলিশ ধরে নেয়ার পর গুলিতে পা হারান চট্টগ্রামের যুবক সাইফ। তার অভিযোগ, পুলিশ কাছ থেকে গুলি করার পর তার পা কেটে ফেলতে হয়েছে। ঘটনার সোয়া এক বছর পর তার মা চট্টগ্রামের আদালতে মামলা করলে অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ আসে। তবে সেই নির্দেশ আট দিনেও যায়নি যেখানে যাওয়ার কথা।

চট্টগ্রামে সাইফুল ইসলাম সাইফ নামে এক যুবকের পায়ে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করার যে অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে, সেটি তদন্ত করতে আদালত যে আদেশ দিয়েছে, তা এক সপ্তাহেও পৌঁছেনি। ফলে তদন্তের কোনো উদ্যোগ এখনও নেয়া হয়নি।

সোয়া এক বছর আগের এই গুলির ঘটনায় সাইফের এক পা কেটে ফেলতে হয়েছে। এর মধ্যেও তাকে নয় মাস কারাগারে থাকতে হয়েছে। নিয়মিত হাজিরা দিতে হয় বিভিন্ন মামলায়।

২০২১ সালের জুনের এই ঘটনায় গত ৪ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের একটি আদালতে মামলা করেন সাইফুলের মা। সেদিনই আসে তদন্তের নির্দেশ।

মামলায় বন্দরনগরীর বায়েজিদ থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কামরুজ্জামানসহ সাতজনকে আসামি করা হয়। অন্যরা হলেন ওই থানারই এসআই মেহের অসীম দাশ, সাইফুল ইসলাম, কে এম নাজিবুল ইসলাম তানভীর ও নুর নবী, এএসআই রবিউল হোসেন এবং পুলিশের সোর্স মো. শাহজাহান ওরফে সোর্স আকাশ।

সেদিনই শুনানি শেষে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনারকে একজন এএসপি পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে দিয়ে অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত। কিন্তু চট্টগ্রাম আদালত ভবন থেকে সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরত্বের পুলিশ লাইনসে সেই আদেশ এক সপ্তাহেও পৌঁছেনি।

আদালতের আদেশ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার দপ্তরে পৌঁছাতে প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করার কথা জানিয়েছেন মামলার বাদী ছেনোয়ারা বেগমের আইনজীবী কাজী মফিজুর রহমান।

নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমাদের কাজ হচ্ছে আদেশের একটা কপি সত্যয়িত করে , মানে টিসি কপি বেঞ্চ সহকারীকে জমা দেয়া। আমরা জমা দিয়েছি, পরবর্তীতে তিনি সেরেস্তাদের মাধ্যমে কপিটা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার কাছে পাঠাবেন। পুরো কাজটাতে সাধারণত দুই দিন সময় লাগে।’

রোববার রাত পর্যন্ত আদেশের কপি পুলিশ লাইনে আসেনি বলে জানান পুলিশ কমিশনারের স্টাফ অফিসার দেলোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমি কমিশনার মহোদয়ের সাথে এই বিষয়ে আলাপ করেছিলাম, তিনি জানাতে পারেননি।’

এই বিষয়ে জানতে অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (জনসংযোগ) আরাফাতুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন তিনি।

পরে আরাফাতুল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আদালতের আদেশ এখনও এসে পৌঁছায়নি। আসলে আমি জানতে পারতাম।’

বাদীর আইনজীবীর সত্যায়িত করা আদেশের কপি সেরেস্তাকে দিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার কাছে পাঠানোর দায়িত্ব বেঞ্চ সহকারীর। ৪ অক্টোবর মামলা দায়েরের দিন সংশ্লিষ্ট আদালতের বেঞ্চ সহকারী বখতিয়ার ছুটিতে থাকায় ভারপ্রাপ্ত বেঞ্চ সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন আদালতের নকল শাখার মো. জসীম উদ্দিন।

এই বিষয়ে জানতে জসীম উদ্দিনের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তার সাড়া মেলেনি।

যা বলা হয় এজাহারে

মামলায় বলা হয়, ২০২১ সালের ১৬ জুন রাত সাড়ে ৯টার দিকে জরুরি কথা আছে বলে ছাত্রদল নেতা সাইফুলকে অক্সিজেন এলাকার হোটেল জামানে ডাকেন পুলিশের সোর্স আকাশ।

সে সময় সাইফ পারিবারিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দক্ষিণ পতেঙ্গায় ছেনোয়ারা হোটেল অ্যান্ড বিরিয়ানি হাউসে যাওয়ার উদ্দেশে বাসা থেকে মোটরসাইকেল নিয়ে বের হয়েছিলেন। আকাশের ফোন পেয়ে রাত ১০টার দিকে অক্সিজেন এলাকার হোটেল জামানে যান তিনি।

হোটেল জামানে পুলিশের সোর্স আকাশের সঙ্গে কথা বলার সময় ওসি কামরুজ্জামান, এসআই মেহের অসীম দাশ, সাইফুল, তানভীর, নুর নবী, এএসআই রবিউল ও অজ্ঞাত দুই পুলিশ সদস্য গিয়ে সাইফুলকে আটক করেন। এ সময় তার মোবাইল ও মোটরসাইকেলের চাবি ছিনিয়ে নিয়ে একটি সাদা রঙের প্রাইভেট কারে উঠিয়ে নিয়ে যায় পুলিশ।

কিছু দূর যাওয়ার পর ওসি অজ্ঞাত ব্যক্তিকে ফোন করে বলেন, ‘সাইফুলকে গ্রেপ্তার করেছি, তাকে আজকেই ফিনিস করব। তোমরা ইউনিফর্ম পরে জামান হোটেলে যাও এবং সেখানকার গত ২ ঘণ্টার সিসি ফুটেজ ডিলিট করে দাও। এটা এডিসি স্যারের নির্দেশ।’

পরে শহরের বিভিন্ন স্থানে ২ ঘণ্টা ধরে ঘুরে রাত ১২টা থেকে ১টার মধ্যে বায়েজিদ লিংক রোড এলাকায় পৌঁছায় প্রাইভেট কারটি। সেখানে ওসি ও এসআই মেহের গাড়ি থেকে নেমে কিছু সময় কথা বলেন। এ সময় সোর্স আকাশ একটি থলে নিয়ে ওই জায়গায় আসেন।

পরে এসআই মেহের গাড়িতে উঠে সাইফুলকে বলে, ‘ওপর থেকে তোমাকে ক্রস ফায়ারের অর্ডার আছে। তুমি ৫ লাখ টাকা দিলে তোমাকে আমরা ছেড়ে দেব।’

এ সময় পরিবার এত টাকা দিতে পারবে না বলে জানান সাইফুল। তিনি তার অপরাধ কি জানতে চেয়ে আদালতে সোপর্দ করার অনুরোধ করেন পুলিশকে।

এরপর আসামিরা তার মুখ বেঁধে গাড়ি থেকে নামায়। এ সময় এসআই মেহের, এসআই তানভীর ও এএসআই সাইফুল তাকে উপুড় করে মাটিতে চেপে ধরেন। এরপর ওসি কামরুজ্জামান তার বাম পায়ের হাঁটুর ওপর-নিচে এক রাউন্ড গুলি করেন। এসআই মেহেরও একই স্থানে এক রাউন্ড গুলি করেন। গুলিবিদ্ধ হয়ে সাইফুল জ্ঞান হারান।

জ্ঞান ফিরে নিজেকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আবিষ্কার করেন সাইফুল। চিকিৎসকের পরামর্শে তাকে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে তার বাম পায়ের হাঁটুর ওপর থেকে কেটে ফেলা হয়।

ড্রেসিংয়ের পর অস্ত্র পাওয়া গেছে বলে অস্ত্র আইনে সাইফুলের বিরুদ্ধে মামলা করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায় পুলিশ।

কিছুই বলবেন না ওসি

সাইফের তোলা এই অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের বায়েজিদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুজ্জামান কোনো কিছুর জবাব দিতে রাজি হননি। তিনি বলেন, “আমি আগেও বলেছি, যেহেতু এটি তদন্তাধীন বিষয়, তাই এটা নিয়ে আমি কোনো কথা বলব না। তবে ‘বার্মা সাইফুল’ লিখে গুগলে সার্চ করলে ২০১০ সালের পর অনেক কিছুই পাবেন।”

চট্টগ্রামের বায়েজিদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কামরুজ্জামান। ছবি: নিউজবাংলা

এই পুলিশ কর্মকর্তার কথামতো গুগলে সার্চ দেয়ার পর অনলাইন পোর্টাল বাংলা ট্রিবিউনের একটি সংবাদ পাওয়া গেছে। এতে লেখা হয়, ‘পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী মো. সাইফুল ইসলাম প্রকাশ ওরফে বার্মা সাইফুলকে গ্রেপ্তার করেছে বায়েজিদ থানা পুলিশ।

‘বুধবার (১৭ জুন) দিবাগত রাত ২টার দিকে বায়োজিদ লিংক রোডের এলাকা থেকে তাকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় গ্রেপ্তার করা হয়। নগর পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত উপকমিশনার (ডিবি- দক্ষিণ) শাহ আব্দুর রউফ এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।’

“তিনি বলেন, ‘বুধবার রাতে সাইফুলকে লিংক রোড এলাকার এশিয়ান ওম্যান ইউনিভার্সিটির গেটের সামনে থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তার কাছ থেকে একটি এলজি ও ৬ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়’।”

২৪ জুন দৈনিক যুগান্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বায়েজিদ বোস্তামী এলাকায় সরকারি জমি দখল করে বার্মা কলোনি গড়ে তোলা হয়েছে। এখানে বসবাসকারী বেশির ভাগই মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। এ কারণে এটি বার্মা কলোনি হিসেবে পরিচিত। এখানে সাইফুলের গোটা পরিবার বাস করে। দুই ভাইকে নিয়ে সাইফুল এখানে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন। লোকজনকে তারা আতঙ্কের মধ্যে রেখেছেন। স্থানীয়রা তাদের ভয়ে কথাও বলতে পারে না। বার্মা কলোনির সরকারি জমি তারা বিভিন্ন সময় মানুষের কাছে বিক্রিও করেছেন। এ ছাড়া সেখানে বসবাসকারীদের মাসে মাসে চাঁদা দিতে হয়। ওই এলাকার বাসিন্দা নজরুল ইসলাম জানান, সাইফুল ও তার অপর দুই ভাই সবুজ ও সামশু সরকারি জমি দখল করে বিক্রি করে। কেউ ভবন নির্মাণ করলে তাদের চাঁদা দিতে হয়। নয়তো তাদের কাছ থেকে চড়া দামে ইট-বালুসহ নির্মাণসামগ্রী নিতে হয়।’

আরেক পুলিশ কর্মকর্তা বললেন বন্দুকযুদ্ধের চিরাচরিত গল্প

সাইফ কীভাবে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন জানতে চাইলে তার মায়ের করা মামলার দ্বিতীয় আসামি বায়েজিদ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) অসীম মেহের দাস নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গ্রেপ্তারের পর হয়তো তাকে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধারে গিয়েছিল। তখন ওর লোকজন পুলিশের ওপর হামলা করে। হামলায় অভিযানে থাকা অফিসারদের কয়েকজনও আহত হয়েছিলেন।’

কারা হামলা করেছিল, তাদের চিহ্নিত করা গেছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কারা বলতে সাইফুলের লোকজন।’

এই লোকজনগুলোই বা কারা, তদন্ত বা সাইফুলকে জিজ্ঞাসাবাদে তাদের নাম বেরিয়ে এসেছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দুজনকে আমরা শনাক্ত করতে পেরেছিলাম। তারা মোটরসাইকেলযোগে এসেছিল। বাকিদের শনাক্ত করা হয়নি বিধায় বাকিদের নামে চার্জশিটও দেয়া হয়নি। তবে এই মুহূর্তে নামগুলো মনে পড়ছে না আমার।’

বায়েজিদ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) অসীম মেহের দাস

তার বিরুদ্ধে মামলায় করা অভিযোগের বিষয়ে এই ‍পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘সে সময় তার বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়েছিল; একটা অস্ত্র আইনে ও অন্যটি পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায়। দুই মামলায় আমি তদন্ত কর্মকর্তা ছিলাম। যেহেতু ওই দুই মামলার সবকিছু আমি যাচাই-বাছাই করেছি, ওই দৃষ্টিকোণ থেকে আক্রোশের বশবর্তী হয়ে আমার নাম জড়িয়ে বিভিন্ন কথাবার্তা বলছে।

‘দিন-রাত যেভাবে সত্য, সে যা বলেছে তা এর বিপরীতভাবে মিথ্যা। তার ওই কথার একটা যৌক্তিকতা, কোনো প্রমাণ সে উপস্থাপন করতে পারবে না। এবং যেটা সত্য না, সেটা সে কীভাবে বলবে?’

অন্য এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সে (সাইফ) মামলা করেছে আদালতে, পুলিশ কমিশনার মহোদয়কে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন, সেটা তদন্তে স্যাররা দেখবেন।’

এ বিভাগের আরো খবর