তার নাম সাইফুল ইসলাম। ডাকনাম মানিক। তবে ছাত্তার নামের ছদ্মবেশ নিয়ে লুকিয়ে ছিলেন তিনি। জাতীয় পরিচয়পত্রও বানিয়েছেন এই নামে। আর এভাবে ৩৪ বছর ধরে পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে ভিন্ন এক জীবনযাপন করছিলেন খুনের মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত এ আসামি।
মানিক দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের একটি চরমপন্থি দলের সদস্য। ১৯৮৭ সালে নাটোরের গুরুদাসপুর থানা লুট করে একজন কনস্টেবল খুন করেছিল চরমপন্থিদের যে গ্রুপ, সেই গ্রুপে মানিকও ছিলেন। তারা ওই থানা থেকে অস্ত্রশস্ত্র লুট করেছিলেন।
সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে বেড়ানো এ চরমপন্থি আসামিকে সাড়ে তিন দশক পর অবশেষে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের এলিট ফোর্স র্যাব। বৃহস্পতিবার রাতে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ এলাকা থেকে মানিককে গ্রেপ্তার করে র্যাব-৩।
শনিবার কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাব-৩-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ।
কী ঘটেছিল থানা লুটের সময়
র্যাব অধিনায়ক জানান, ১৯৮৭ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার হাটের দিন বেলা ১১টার দিকে লুঙ্গি, গামছা পরা অবস্থায় হাতে পোটলা নিয়ে একদল চরমপন্থি হাটের মধ্যে ছদ্মবেশে ঘোরাফেরা করতে থাকে। পোটলার মধ্যে তাদের অত্যাধুনিক অস্ত্র লুকানো ছিল। তাদের মধ্যে কিছু লোক অস্ত্র প্রদর্শন করে টেলিফোন অফিস নিয়ন্ত্রণে নিয়ে টেলিফোন লাইন বিকল করে দেয় এবং কয়েকজন জিডি করার অজুহাতে থানায় ঢুকে অস্ত্রের মুখে থানার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়।
এ সময় থানায় কনস্টেবল হাবিবুর রহমান বাধা দিলে চরমপন্থিরা তাকে গুলি করে হত্যা করে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে। তারা থানার অস্ত্রাগার লুট করে দুটি এসএমজি, চারটি এসএলআর, ১৮টি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল ও গোলাবারুদ লুট করে থানার লকআপে বন্দি চরমপন্থি আসামিকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। তারপর আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য তারা একযোগে টেলিফোন অফিস ও থানা কম্পাউন্ডে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়।
এ ঘটনায় অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে নাটোরের গুরুদাসপুর থানায় ওই দিনই বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলা হয়। এ মামলার তদন্ত শেষে সিআইডির তদন্তকারী কর্মকর্তা ২০ জন আসামিকে গ্রেপ্তার করেন। তাদের একজন চরমপন্থি মানিক।
গ্রেপ্তার আসামিদের জবানবন্দি, সাক্ষীদের সাক্ষ্য ও পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যের ভিত্তিতে মানিকসহ ৪৯ জনকে আসামি করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়। বিচারপ্রক্রিয়া শেষে ২০০৭ সালে মামলার রায় ঘোষণা করে আদালত।
গ্রেপ্তার আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে র্যাব অধিনায়ক জানান, মানিক ১৯৮৪ সালে চরমপন্থি নেতা তারেকের মাধ্যমে পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি লাল পতাকা ওরফে সর্বহারা দলে যোগ দেন। চরমপন্থি নেতা তারেক প্রতি সপ্তাহে চাটমোহর এলাকায় উঠতি বয়সের যুবকদের বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে উঠান বৈঠক করতেন। এ বৈঠকে তিনি আকর্ষণীয় কথাবার্তা বলতেন। কেউ তাদের কাজে বাধা দিলে তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়ার কথা বলতেন। যদি সরকার বা সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তারা পুলিশ হত্যা করে থানা ফাঁড়ি লুট করতে পিছপা হবেন না বলে কর্মীদের নির্দেশ দেন তিনি।
র্যাব অধিনায়ক আরও জানান, এমন আকর্ষণীয় কথায় মুগ্ধ চরমপন্থিরা হত্যা, লুটপাট, ত্রাস সৃষ্টি ও অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির কাজে অংশগ্রহণ করতে থাকে। চরমপন্থি দলে যোগ দেয়ায় এলাকার সবাই মানিককে সমীহ করত। যাদের সঙ্গে তার বিরোধিতা ছিল, চরমপন্থিদের আশ্রয়ে থাকায় সবাই তার সঙ্গে আপস- মীমাংসা করে নেয়।
চরমপন্থি নেতা তারেক এ ঘটনার দুই মাস আগে থেকে গুরুদাসপুর থানা লুট করার পরিকল্পনা করেন। এ জন্য তিনি ঝিনাইদহ, সিরাজগঞ্জ, রাজবাড়ী, কুষ্টিয়া, পাবনা, টাঙ্গাইল এলাকা থেকে চরমপন্থি দলের সদস্যদের আহ্বান জানিয়ে একত্রিত করেন।
ঘটনার দিনের বর্ণনা দিয়ে র্যাব-৩-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ঘটনার দিন তারা বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় ৬০ জন নাটোরের ধামাইর মাঠে এসে জড়ো হয়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী ছদ্মবেশে লুঙ্গি, গামছা পরা অবস্থায় পোটলার মধ্যে অস্ত্র লুকিয়ে গুরুদাসপুর থানা ও টেলিফোন অফিসের আশপাশ এলাকা এবং হাট এলাকায় অবস্থান নেন। ঘটনার এক সপ্তাহ আগে থেকেই কয়েকজন সার্বক্ষণিক টেলিফোন অফিসের কর্মী এবং গুরুদাসপুর থানার ফোর্সের গতিবিধির ওপর নজরদারি করছিলেন।
‘সবুজ সংকেত পাওয়ামাত্র সুলতানের নেতৃত্বে পাঁচজন টেলিফোন অফিসে ঢুকে সেন্ট্রাল কমান্ড বিকল করে দেন।
‘অন্যদিকে তারেকের নেতৃত্বে মানিকসহ প্রথমে চারজন জিডি করার জন্য থানায় প্রবেশ করেন এবং মজিদের নেতৃত্বে ১০ জন থানা ব্যারাকে প্রবেশ করে সব পুলিশ সদস্যকে কক্ষের মধ্যে বন্দি করে রাখেন। লুণ্ঠিত অস্ত্র তারেক, সুলতান, মজিদ এবং ইয়াকুব তাদের হেফাজতে নিয়ে চাটমোহর ও চলনবিল এলাকায় লুকিয়ে রাখেন।
‘ঘটনা শেষে মানিক তার বাড়িতে গিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে থাকেন। পরের বছর ১৯৮৮ সালে তারেকের নেতৃত্বে চাটমোহর থানার খোতবাড়ি এলাকায় মাঠের মধ্যে রাতে নকশালপন্থি এবং সর্বহারাদের মধ্যে সম্মুখযুদ্ধ হয়। যুদ্ধে নকশালপন্থি ১২ জন নিহত হন।’
লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এ ঘটনার পর মানিকসহ সর্বহারা দলের সদস্যরা চলনবিলে গোসল করে যার যার বাড়িতে চলে যান। ভোর হলে পুলিশ ১২টি লাশ উদ্ধার করে থানায় মামলা করে। এ মামলায় মানিক গ্রেপ্তার হন। এ ঘটনায় গ্রেপ্তারদের জিজ্ঞাসাবাদে গুরুদাসপুর থানার অস্ত্র লুটের সত্যতা বেরিয়ে আসে।
‘এ মামলাগুলোতে জামিনে মুক্ত হয়ে মানিকের পলাতক জীবন শুরু হয়। থানা লুট ও ১২ জনকে হত্যা মামলাসহ মানিকের বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা রয়েছে।’