চাঁপাইনবাবগঞ্জের আব্দুল খালেকের হাত থেমে গেলেই থেমে যাবে একটি জ্ঞান।
৬৪ বছর বয়সী এই মানুষটির হাত ধরেই এখনও জেলায় ভেড়ার লোম দিয়ে তৈরি হয় কম্বল। কিন্তু তিনি সেই জ্ঞান ছড়িয়ে দিতে পারেননি তার সন্তান বা পরবর্তী প্রজন্মের কারও কাছে। কারণ অন্য কেউ এই পেশায় উৎসাহী নয়।
ভেড়ার লোম কয়েকটি ধাপে প্রক্রিয়াজাত করে তৈরি হয় সুতা আর সেই সুতার বুননে তৈরি করেন কম্বল, জায়নামাজ, মাফলারসহ বেশকিছু পণ্য।
বাবার কাছে শেখা শিখেছেন এই কৌশল। পরিবারের কেউ শিখতে না চাওয়ায় তিনি চাইছেন সরকারিভাবে একটা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হোক। তাতে অন্য কাউকে তিনি শিখিয়ে যেতে পারবেন এই কৌশল, যাতে অন্তত টিকে থাকবে শিল্পটা।
খালেক জানালেন, তিনি এই পেশায় কমছে কম ৫০ বছর ধরে। সেই কিশোর বয়সেই শেখা। পৌরসভার নয়াগোলা এলাকার মোমিনপাড়া এলাকায় নিজ বাড়িতে এখনও করছেন এই কাজ।
বাড়িতে ঢুকতেই দেখা গেল চরকায় সুতা কাটছেন। আলপচারিতায় জানালেন, লোম থেকে সুতা তৈরির সেই কৌশল। জানালেন, ভেড়ার খামার থেকে লোম সংগ্রহ করে সেই লোম পানি দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করতে হয়। এরপর শুকানোর পালা আর লোমের রং অনুসারে আলাদা করার পালা। এরপর সেই লোম দিয়ে চরকাতে তৈরি করতে হয় সুতা। সেই সুতা দিয়েই হাতে চালানো তাঁতে বোনা হয় কম্বল। এরপর সেই কম্বল পা ও হাত দিয়ে মাড়িয়ে করা হয় নরম।
এই ভেড়ার লোমের কম্বলের চাহিদা কম নয়। যে পরিমাণ অর্ডার থাকে তা একা হাতে সামাল দিতে পারেন না খালেক। আগে দুই দিনে করতে পারলেও বয়সের কারণে এখন চার হাত বনাম পাঁচ হাত একটি কম্বল তৈরি করতে লেগে যায় ছয় থেকে আট দিন।
তিনি বলেন, ‘আগে আমাদের পাড়ার বা আমাদের আত্মীয় স্বজনরা করত, এখন কেউই করে না এ কাজ। পড়ালেখা করে কেউ কেউ আমাদের বংশের ডাক্তার হয়ে গেছে। আমার ছেলেরাও ব্যবসা-বাণিজ্য করে, এ কাজে কেউ আসেনি। আমিই স্মৃতিটাকে ধরে রেখেছি।
অনেকটা আক্ষেপের সুরে বলেন, ‘কেউ তো শিখতে চাইল না। আমি মরে গেলে কেউ আর বানাবে না এ কম্বল। আমিও শেষ ভেড়ার লোমের কম্বলও শেষ। এখন আমি কবরে চলে যাব, এ আক্ষেপ থেকেই যাবে।’
খালেক চান, সরকারি উদ্যোগ। তিনি শেখাবেন, কিন্তু ‘ছাত্র’র ব্যবস্থা করবে সরকার।
তিনি বলেন, ‘সরকারের কাছে বলেছি, মন্ত্রীর কাছে বলেছি, প্রাণিসম্পদের কর্মকর্তাদের কাছে বলেছি যে, একটা ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করতে, যাতে আমি শিখিয়ে দিয়ে যেতে পারি। সরকারিভাবে উদ্যোগ নিলে আমি খুশি আছি। কিন্তু হচ্ছে না তো।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ বিসিকের সহকারী মহাব্যবস্থাপক রায়হান আলী উদ্যোগ নেয়ার আশ্বাস দেন। তিনি বলেন, ‘আমরা যতটুকু শুনেছি ভেড়ার লোম থেকে কম্বল তৈরি, এখানে একসময় খুব প্রসিদ্ধ ছিল। বর্তমানে এটি প্রায় বিলুপ্তির পথে। আমরা চেষ্টা করব যারা এখন আছেন তাদের মাধ্যমে অন্যদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এ শিল্পটাকে আবার ফিরিয়ে আনার।
‘এ ব্যাপারে আমরা বিসিক প্রধান কার্যালয়ের সঙ্গে কথা বলে একটি বা দুটি প্রশিক্ষণ কর্মশালা আয়োজন করার ব্যবস্থা করব।’