বর্তমান সরকার মানবাধিকার রক্ষার অঙ্গীকার করে এসে তা ভঙ্গ করেছে বলে অভিযোগ করেছেন মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল।
জাতীয় প্রেস ক্লাবে ৯টি নৃগোষ্ঠী ও নাগরিক সংগঠনের যৌথ আয়োজনে সাতক্ষীরার নরেন্দ্র মুন্ডা হত্যা ও ভূমি দখলের প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ অভিযোগ করেন।
গত মাসে সাতক্ষীরার শ্যামনগরে জমি জবরদখলে বাধা দেয়ায় ওই উপজেলার মুন্ডা পল্লীতে নগেন্দ্র মুন্ডাকে হত্যা ছাড়াও নারীসহ কয়েকজনকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে জখম করা হয়।
সুলতানা কামাল বলেন, ‘শ্যামনগরের হামলা ও হত্যার বিচার দাবি করছি। এগুলো যাতে আর না ঘটে, সে জন্য সোচ্চার থাকতে হবে। মানুষের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার ক্ষতিপূরণ রাষ্ট্রকে দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘নারীর সমতা, মানবাধিকার, ন্যায়বিচার ও পাঠ্যপুস্তকে সাম্য নীতি থেকে সরকার সরে যাচ্ছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসেছে মানবাধিকার রক্ষার অঙ্গীকার নিয়ে, কিন্তু তারা সেই অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছে। অঙ্গীকার রক্ষা ও জনগণের অধিকার ও সন্মান রক্ষার বিষয়টি তারা যেন দেখেন।’
সুষম উন্নয়নের দাবি জানিয়ে সুলতানা কামাল বলেন, ‘আমরা উন্নয়ন চাই। যদি উন্নয়নের সুফল সব জনগোষ্ঠী সমানভাবে না পায়, তাহলে সেটি কিসের উন্নয়ন। আমরা স্থিতিশীল ও গণতান্ত্রিক সরকার চাই।
‘একই সঙ্গে সকল মানুষের সমান অধিকার চাই। দেশে প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। বিচারহীনতার কষ্টে এসব নির্যাতিতরা ভুগছে।’
ক্ষমতায় টিকে থাকতে সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ব্যবহার করছে বলেও মন্তব্য করেন সুলতানা কামাল।
তিনি বলেন, ‘যারা বর্তমানে ক্ষমতায় আছেন, তারা ক্ষমতায় টিকে থাকতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ব্যবহার করছেন। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির কাছে সরকার নতি স্বীকার করেছে। তারা চেতনার বাইরে গিয়ে মৌলবাদীদের সঙ্গে আপস নীতি অনুসরণ করছে।
‘আদিবাসীদের ওপর নির্যাতন, হত্যা, ভূমি দখল চলতেই থাকবে, এটা হতে পারে না। তারা আন্দোলন করতে করতেই জীবন পার করবে? রাষ্ট্রের দায়িত্ব জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে মানবাধিকার রক্ষা করা। আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, মানুষের মানবাধিকার রক্ষায় রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়েছে। আর এই দায়ভার রাষ্ট্র পরিচালনাকারীদের বহন করতে হবে।’
পুলিশের ভূমিকা নিয়ে সুলতানা কামাল বলেন, ‘পুলিশি ভূমিকার নিন্দা জানাতে জানাতে আমরা ক্লান্ত। আমরা চাই পুলিশ নিজেদের দিকে ফিরে তাকাক। কেন সংবাদ সম্মেলন করে বিচার চাইতে হবে? সার্বিকভাবে পুলিশ ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে কোনো ঘটনারই সুষ্ঠু সমাধান দিতে পারেনি।’
মামলার বাদী ফনিন্দ্রনাথ বলেন, ‘গত ১৯ আগস্ট জমি নিয়ে বিরোধের জেরে প্রভাবশালী ভূমিগ্রাসী মহলের হামলায় ১২ জন মুন্ডা আদিবাসী আহত হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় আমার চাচা নরেন্দ্রনাথ মুন্ডা মারা যান। জমিটি নিয়ে মামলা চলমান।
‘আমরা বলেছিলাম কোর্টের রায় যা হবে, তা মেনে নেব। তার আগে কিছু নয়, কিন্তু তারা তা না মেনে মারধর করে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা কেউ হামলার পর এগিয়ে আসেনি। ৯৯৯-এ ফোন দিলে পুলিশ আমাদের উদ্ধার করে।
‘হত্যা মামলার আসামি চারজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও প্রধান আসামি রাশিদুল ও এবাদুল এখনও গ্রেপ্তার হয়নি। আমরা অতি দ্রুত এদের বিচার দাবি করছি।’
সংবাদ সম্মেলনে আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং অভিযোগ করেন, ‘আসামিদের গ্রেপ্তারে পুলিশ প্রশাসন যথেষ্ট তৎপর নয়। স্থানীয় জনগণ বলছে পুলিশের ভূমিকা রহস্যজনক; মূল আসামিরা এখনও গ্রেপ্তার হয়নি। ঘটনাস্থলে পুলিশ এসেছে অনেক দেরিতে।’
৯ দাবি
সংবাদ সম্মেলনে সরকার ও সংশ্লিষ্টদের কাছে ৯টি দাবি ও সুপারিশ উপস্থাপন করা হয়।
১. অবিলম্বে নরেন্দ্রনাথ মুন্ডা হত্যার মূল আসামিদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা এবং যথাযথ তদন্ত করে এই ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করা।
২. ধুমঘাট এলাকার মুন্ডা পরিবারগুলোর জীবন ও জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
৩. ১৯৫০ (৯৭) সালের রাষ্ট্রীয় প্রজাস্বত্ব আইন যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিশেষ ব্যবস্থায় মুন্ডাদের জমি ফেরত দেয়া।
৪. মুন্ডাসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর যেসব জমি জাল দলিলের মাধ্যমে বা অন্য কোনো উপায়ে দখল করা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সেসব জমি দখলমুক্ত করে প্রকৃত মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দেয়া।
৫. নিহত নরেন্দ্রনাথ মুন্ডার পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও আহতদের চিকিৎসার খরচসহ ক্ষতিপূরণ দেয়া।
৬. সারা দেশে বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ করা এবং দুষ্কৃতিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা।
৭. অবিলম্বে মুন্ডাসহ সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর জন্য সরকারের প্রতিশ্রুত ভূমি কমিশনের গঠনের উদ্যোগ নেয়া।
৮. ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে অঙ্গীকার করা জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করা।
৯. জেলা প্রশাসকের অনুমতি ছাড়া ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর যেসব জমি হস্তান্তর হয়েছে বা জাল দলিলের মাধ্যমে বেদখল হয়েছে, এসব দলিল বাতিলের জন্য সরকার বা রাষ্ট্রের উদ্যোগ নেয়া।
সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন, মুন্ডাদের অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলন সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক আশিক-ই-এলাহীসহ অনেকে।