জাতীয় পার্টির দুই বলয়ের অন্তঃকলহ দিন দিন বাড়ছে। দলটি আবার ভাঙবে কি না সে প্রশ্ন নতুন করে উঁকি দিলেও দলের বর্তমান নেতারা অবশ্য বলছেন, দল এখন আগের চেয়ে ঐক্যবদ্ধ, দল শক্তিশালী।
দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জকারী অংশটি আগামী কাউন্সিলের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে এটি দলে চিড় ধরাবে কি না তা বোঝার জন্য আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে বলে মনে করছেন দলটির নেতারা।
সাম্প্রতিক টানাপোড়েন প্রশ্নে জাতীয় পার্টির নেতারা বলছেন, দলে কোণঠাসা হয়ে জি এম কাদের বিরোধীরা রওশন এরশাদকে ভুল বুঝিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে দলে নিজেদের আবারও প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছেন রওশনপন্থিরা। জি এম কাদেরপন্থিরা এদের সুবিধাবাদী বলেই আখ্যায়িত করছেন।
জাতীয় পার্টির ভেতরে সর্বশেষ দ্বন্দ্বের পেছনে দলের বর্তমান নেতৃত্বের কারণে কোণঠাসা বোধ করা নেতারা রয়েছেন বলে দলের নীতিনির্ধারণী অংশের অভিযোগ। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের এই অংশটিকে তৃতীয় শক্তি বলে উল্লেখ করেছেন।
দলের নেতারা এও বলছেন, যদি রওশন এরশাদের নেতৃত্বে দল আবার ভাঙে তাতেও মূল দলের কোনো ক্ষতি হবে না। কারণ জাতীয় পার্টির মূল দল এখন জি এম কাদেরের সঙ্গেই আছে।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের। ফাইল ছবি
দলের বর্তমান পরিস্থিতিতে গত শনিবার সভাপতিমণ্ডলীর সভা ডাকেন জি এম কাদের। সভায় সিদ্ধান্ত হয়, জাতীয় পার্টির মূল দলের যারা রওশন অংশের সঙ্গে যাবেন, তাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হবে।
এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আলমগীর শিকদার লোটন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা দলের গত সভাপতিমণ্ডলীর সভায় দেখেছি, মূল দল জি এম কাদেরের নেতৃত্বেই ঐক্যবদ্ধ আছে। জি এম কাদেরের নেতৃত্বে পুরো দল আছে। যদি উনারা (রওশনপন্থিরা) কাউন্সিলও করেন, তাতেও মূল দলের কোনো ক্ষতি হবে না।’
তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, রওশন এরশাদ ঠিক কাজ করছেন না। এটা আমাদের জন্য অনেক দুঃখজনক ও আপত্তিকর। আমরা কেন দুই ভাগে ভাগ হতে যাব? এটা তো আমরা রওশন এরশাদের কাছে আশা করি না।’
কাউন্সিল হলে জাতীয় পার্টি আবার ভাঙবে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা জানতে কিছুদিন সময় লাগবে। তবে আমি মনে করি, ওই পর্যন্ত তারা যেতে পারবে না।’
রওশন এরশাদের সঙ্গে কারা আছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যারা পরিশ্রম ছাড়াই দলের এমপি হতে চান, তারাই এখন রওশন এরশাদের সঙ্গে এসে জুটেছেন। সুযোগ সন্ধানী লোকগুলো রওশন এরশাদের নেতৃত্বে দলকে ভাঙতে চায়। এরা দালালি পছন্দ করেন, এরা তাই করছেন।’
২০১৯ সালের ১৪ জুলাই এরশাদের মৃত্যুর পর থেকে জাতীয় পার্টিতে দুটি বলয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে একাংশের নেতৃত্ব দিতে থাকেন রওশন এরশাদ। তবে এরশাদ তার ভাই জি এম কাদেরকে দলের নেতৃত্ব দিয়ে যান। এরপর জি এম কাদের রওশনকে দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক করেন। পাশাপাশি তিনি জাতীয় সংসদে হন বিরোধীদলীয় উপনেতা। সে সময় জি এম কাদের ও রওশনের মধ্যে যে মীমাংসা হয়, সে অনুসারেই সবকিছু চলছিল।
সম্প্রতি অসুস্থ হয়ে দেশের বাইরে গিয়ে দলের ভূমিকায় অসন্তুষ্ট হন রওশন এরশাদ। জি এম কাদের এবং তার অনুসারীরা তার খোঁজ না নেয়ায় গত ২ জুলাই দলের একটি মতবিনিময় সভায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন রওশন। এই সভায় দলে ইতিমধ্যে কোণঠাসা নেতারা উপস্থিত থাকলেও জাতীয় পার্টির মূল দলের কেউ উপস্থিত ছিলেন না।
জাতীয় পার্টির নেতারা বলছেন, রওশনের এই অসন্তোষের সুযোগ নিচ্ছেন জাতীয় পার্টির কেউ কেউ, যাদের একটি অংশ একসময় জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য হলেও আগামীতে তাদের দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।
এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া নিউজবাংলাকে বলেন, ‘রওশন এরশাদকের উল্টো বুঝিছে তৃতীয় একটি পক্ষ সুবিধা করার চেষ্টা করছে, যা আমাদের দলের চেয়ারম্যানও বলেছেন। কিন্তু তারা সুবিধা করতে পারবে না।’
তৃতীয় পক্ষ বলতে কাদেরকে বোঝানো হচ্ছে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তারা ওনার (রওশন) পাশেই থাকেন। উনি দেশে এসে হোটেল ওয়েস্টিনে যে সভা করছিলেন, সেই সভায় যারা উপস্থিত ছিলেন, তারাই হলেন সেই তৃতীয় পক্ষ।’
এ বিষয়ে জি এম কাদের বিরোধী হিসেবে পরিচিত দলের সাবেক সংসদ সদস্য প্রফেসর দেলোয়ার হোসেন খানের কাছে জানতে চাইলে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি রওশন এরশাদের সঙ্গে আছি। কিন্তু এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। আপনি গোলাম মসিহ কিংবা কাজী মামুনুর রশিদের সঙ্গে কথা বলেন।’
জি এম কাদের বিরোধী হিসেবে পরিচিত ও এরশাদ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান কাজী মামুনুর রশিদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কোনোভাবেই জি এম কাদেরের সঙ্গে কোনো মীমাংসা হবে না। শুধু যদি তিনি (জি এম কাদের) রওশন এরশাদের নেতৃত্ব মেনে নেন, তাহলেই মীমাংসা হওয়া সম্ভব।’
তিনি বলেন, ‘ম্যাডাম (রওশন) যদি মীমাংসায় রাজি হন, তাহলে হবে, কিন্তু জি এম কাদেরের নেতৃত্বে কোনো মীমাংসা হবে না।’
এক প্রশ্নের জাবাবে তিনি দাবি বলেন, ‘আপনাদের যে গঠনতন্ত্র দেওয়া হয়েছে, সেটা আসলে দলের আসল গঠনতন্ত্র নয়। গঠনতন্ত্র যেটা কাউন্সিলে পাস হয়েছে, সেখানে স্পষ্ট বলা হয়েছে সর্বময় ক্ষমতা রওশন এরশাদের। যে গঠনতন্ত্র আপনারা পেয়েছেন, সেটা হলো জি এম কাদেরের বানানো গঠনতন্ত্র।’
তাদেরকে ‘দলবিরোধী ষড়যন্ত্রে’ লিপ্ত হওয়ার অভিযোগ তোলা হচ্ছে উল্লেখ করা হলে তিনি বলেন, ‘আপনারা অপেক্ষা করেন। দেখেন কার সঙ্গে কে থাকে।’
রওশন এরশাদের ডাকা কাউন্সিলের প্রস্তুতি নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা সম্মেলনের একটি অংশবিশেষ আজকে পেয়েছি। বাকি অংশটি বিরোধীদলীয় নেতার (রওশন) অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। এর পর সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির একটি সভার করব।’
তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি রওশন এরশাদ জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাকালীন একজন। তিনি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের স্ত্রী। প্রতিষ্ঠাকালীনও তার অনেক শ্রম ছিল।’
জাতীয় পার্টিতে আগের যত ভাঙন
সেনাপ্রধান হিসেবে ক্ষমতা দখল করে এরশাদ তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আগে ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি জাতীয় পার্টি গঠন করেন। গণ-অভ্যুত্থানে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদ ক্ষমতা হারানোর পর ওই দশকেই দলে প্রথম ভাঙন ধরে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠন করলে তাতে যোগ দেয় জাতীয় পার্টি। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান দলটির নেতা আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। পরে এরশাদ বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ হলে মঞ্জু তাতে যোগ না দিয়ে দল ভেঙে গঠন করেন জাতীয় পার্টি-জেপি।
পরে ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে আগে এরশাদ চারদলীয় জোট ছেড়ে গেলে দলে আবার ভাঙন ধরে। দুই প্রভাবশালী নেতা নাজিউর রহমান মঞ্জুর ও এম এ মতিন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি গঠন করে চারদলীয় জোটে থেকে যান।
২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে এরশাদ আওয়ামী লীগের সঙ্গে মহাজোট করলেও ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে নানা ঘটনাপ্রবাহে নিজের অবস্থান বারবার পাল্টান। একবার ভোটে যাবেন, একবার যাবেন না বলে ঘোষণার মধ্যে ক্ষুব্ধ হয়ে নতুন জাতীয় পার্টির ঘোষণা দেন কাজী জাফর আহমেদ। এর আগে একে অপরকে পাল্টাপাল্টি বহিষ্কারও করে তারা। ওই নির্বাচনের আগে আগে এরশাদ ভোট বর্জনের ঘোষণা দিলে জাতীয় পার্টির একাংশ তার স্ত্রী বেগম রওশন এরশাদকে চেয়ারম্যান ঘোষণা দিয়ে ভোটে যান। ভোট শেষে দলে অবশ্য আর বিভক্তি তৈরি হয়নি।