নারায়ণগঞ্জে বিএনপির নেতা-কর্মীদের দিকে রাইফেল দিয়ে গুলি করেছেন গোয়েন্দা পুলিশের যে কর্মকর্তা, সেটি তার ছিল না। তিনি অন্য একজনের হাত থেকে রাইফেল নিয়ে গুলি করেছেন।
নারায়ণগঞ্জের পাবলিক প্রসিকিউটর মনিরুজ্জামান বুলবুল বলেন, অন্যের অস্ত্র ব্যবহার করা যায় কেবল আত্মরক্ষার্থে। আক্রমণের জন্য ব্যবহারের সুযোগ নেই।
গোয়েন্দা বাহিনীর উপপরিদর্শক মাহফুজুর রহমান কনকের এই গুলি করা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন এখন উত্তপ্ত। গত ১ সেপ্টেম্বর বিএনপির ৪৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে নারায়ণগঞ্জে দলটির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের সময় গুলিতে নিহত হন শাওন প্রধান, যাকে যুবদল কর্মী উল্লেখ করে দেশজুড়ে বিক্ষোভ করছে দলটি।
সেদিনের ঘটনার ভিডিও ও স্থিরচিত্রে দেখা যায়, বিএনপির নেতা-কর্মীরা যখন পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়ছিলেন, তখন কনক দাঁড়িয়ে, নিচের দিকে খানিকটা ঝুঁকে এবং হাঁটু গেড়ে সরাসরি নেতা-কর্মীদের দিকে গুলি করছেন।
এ ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও এটি নিয়ে কোনো তদন্তের উদ্যোগ নেয়নি পুলিশ। বিএনপির করা একটি মামলার আবেদনও ফিরিয়ে দিয়েছে আদালত।
এ ঘটনার পর পাঁচ দিন ধরে কনক নারায়ণগঞ্জের গোয়েন্দা অফিসেই দায়িত্ব পালন করছেন। তবে তাকে এরপর আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি।
লাঠি নিয়ে ঘটনাস্থলে যান কাকন
পুলিশ কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন, সেদিন কনককে কোনো অস্ত্র দেয়া হয়নি। তিনি সেখানে যান হাতে লাঠি নিয়ে। সংঘর্ষ চলাকালে তিনি অন্য এক পুলিশ সদস্যের কাছ থেকে অস্ত্র নিয়ে গুলি করেন।
একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, সংঘর্ষের আগে মাহফুজ কনক অন্য ডিবি পুলিশদের সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছেন। কনকের ডান হাতে একটি লাঠি আর বাম হাতে ওয়্যারলেস। আরেক অংশে দেখা যায় কনকের হাতে চাইনিজ রাইফেল। তিনি গুলি করছেন বিএনপির নেতা-কর্মীদের দিকে।
কনক সেই ঘটনার চার বা পাঁচ দিন আগে ভোলা থেকে নারায়ণগঞ্জে বদলি হয়ে আসেন। তিনি ভোলায় থাকাকালেও পুলিশের গুলিতে বিএনপির মিছিলে দুই জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে সেই গুলি কে বা কারা ছুড়েছিল, সেটি প্রকাশ পায়নি।
নারায়ণগঞ্জ পুলিশের পরিদর্শক শরফুদ্দিন ভূঁইয়া জানান, শটগান ও রাইফেল থাকে কনস্টেবলদের কাছে। উপপরিদর্শকের (এসআই) কাছে পিস্তল থাকে। তবে কারো কারো কাছে শটগান থাকে।
মাহফুজ কনক যে রাইফেল দিয়ে গুলি করেছে, সেটি কার দায়িত্বে ছিল, সে প্রশ্নের জবাব দিতে পারেননি শরফুদ্দিন।
তবে নারায়ণগঞ্জ পুলিশ লাইনসে কর্মরত একাধিক পুলিশ সদস্য নিশ্চিত করেছেন, রাইফেলটি ছিল লিটন নামের এক পুলিশ সদস্যের। তার পুরো নাম অবশ্য জানাতে পারেননি তারা। এই নামেই ডাকেন বলে জানান।
তদন্তের উদ্যোগ নেই
সেদিন নেতা-কর্মীদের ওপর সরাসরি গুলি করার মতো পরিস্থিতি ছিল কি না এই বিষয়টি নিয়ে যেমন কোনো তদন্তের উদ্যোগ নেই, তেমনি অন্য একজনের অস্ত্র দিয়ে কেন গোয়েন্দা বাহিনীর উপপরিদর্শক গুলি করেছেন, সেটি নিয়েও কোনো জবাবদিহির দৃশ্যমান উদ্যোগ নেই।
নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আমির খসরুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ডিবি পুলিশের রাইফেল দিয়ে গুলি করার বিষয় নিয়ে এখন কথা বলার সময় নয়।’
মাহফুজ কার রাইফেল নিয়ে গুলি করলেন, সেখানে গুলি করার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল কি না– এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেলের মোবাইল ফোনে অন্তত ১০ বার কল করা হয়। তবে তিনি ফোন ধরেননি।
অন্যের অস্ত্র ব্যবহারের সুযোগ আছে কি?
একজনের অস্ত্র আরেকজন ব্যবহার করতে পারেন না বলে নিউজবাংলাকে জানিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ পুলিশের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা। তবে তিনি নাম প্রকাশে রাজি হননি।
তিনি বলেন, ‘সাধারণত যার অস্ত্র তিনি ব্যবহার করবেন। অন্যজন করতে পারবেন না। তবে যদি কোনো কারণে তিনি তা করতে না পারেন এবং সেই সময় যদি জানমালের ক্ষতির মুখে পড়েন, তাহলে অন্য কেউ সেটি ব্যবহার করতে পারবে।
নারায়ণগঞ্জ জজ কোর্টে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মনিরুজ্জামান বুলবুল বলেন, ‘আইনে বলা হয়েছে যে পুলিশ সদস্যের দায়িত্বে অস্ত্র থাকবে, তিনি আত্মরক্ষার্থে তা ব্যবহার করতে পারবেন। কিন্তু একজনের অস্ত্র আরেকজন ব্যবহার করতে পারেন না।’
অন্যের অস্ত্র দিয়ে কনক যে গুলি করেছেন, তাতে তার বিরুদ্ধে তদন্তের কোনো উদ্যোগ নেয়া হবে কি না, জানতে চাইলে জেলা গোয়েন্দা শাখার প্রধান ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তরিকুল ইসলাম কোনো উত্তর দেননি।
তিনি জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আমির খসরুর সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। তবে তিনি এই বিষয়ে প্রশ্ন শুনে ‘মিটিংয়ে আছি’ বলে কেটে দেন আমির খসরু।