নদী, খাল-বিল ও জলাশয়ে রাক্ষুসে মাছ হিসেবে পরিচিত বোয়াল। একসময় জেলেদের জালে বোয়াল বেশি ধরা পড়ত। একেকটা বোয়ালের ওজন হতো পাঁচ থেকে দশ কেজি। নদী-খালে জেলের জালে বোয়াল মাছ আটকালে তা টেনে তীরে তোলার মাঝেও ছিল এক রকম বীরত্ব। বাজারে এই মাছের চাহিদাও ছিল বেশ। সময়ের আবর্তে সুস্বাদু বোয়াল মাছ এখন বিপন্নপ্রায়।
এই মাছ বাণিজ্যিকভাবে চাষ শুরু করেছেন কুমিল্লা ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার মৎস্য চাষি মো. শহীদুল ইসলাম। গত বছর বিভিন্ন জেলে ও মাছ শিকারিদের কাছ থেকে বোয়ালের পোনা সংগ্রহ শুরু করেন তিনি। প্রতিটি বোয়ালের পোনা ২০ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত দিয়ে পুকুরে ছাড়েন। বছর ঘুরতেই একেকটা বোয়াল ২ থেকে ৩ হাজার টাকায় বিক্রি করেন। এই ছোট সফলতায় এখন বোয়াল নিয়ে বড় স্বপ্ন দেখছেন শহীদুল।
কথা হয় শহীদুল ইসলামের সঙ্গে। তার বাড়ি কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার শিদলাই ইউনিয়নের লাড়ুচো গ্রামে। বাবা মরহুম আব্দুর সাত্তার। শহীদুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯২ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স সম্পন্ন করেন। তারপর শুরু করেন মাছ চাষ। তার খামারে ৭-৮ জন কর্মী কাজ করেন। রুই-কাতলা, মৃগেল, কার্প, তেলাপিয়াসহ অন্যান্য মাছ চাষ করছেন শহীদুল। গত কয়েক বছরে উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে মৎস্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সেরা মৎস্য চাষি হিসেবে সনদ ও সম্মাননা পেয়েছেন।
শহীদুল বলেন, ‘ছোটবেলায় কনুই জাল, ছটকি (মাছ ধরার টোপ) দিয়ে কত বোয়াল মাছ ধরছি। আগে বর্ষাকালে খালে জাল ফেলতাম। এখন আর সেই বোয়াল মাছ নেই। তাই আগের দিনের সেই বোয়াল মাছকে ফিরিয়ে আনতে আমি উদ্যোগ নিয়েছি। এটা রাক্ষুসে মাছ বলে পুকুরে কেউ চাষ করতে চায় না। আমি বোয়ালের জন্য আলাদা পুকুর করেছি। এই পুকুরে শুধু বোয়াল চাষ করব। আমার লক্ষ্য খালে-বিলে-নদীতে যেন আবারও বোয়াল মাছের ছড়াছড়ি শুরু হয়।’
শহীদুল জানান, চলতি বছরের শুরুতে তিনি বাণিজ্যিকভাবে বোয়াল চাষের উদ্যোগ নেন। নিজ এলাকা ও পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকার বেসাল (বেল) জাল ও জেলেদের কাছ থেকে ২০ টাকা থেকে শুরু করে ৫০ টাকা দরে ৪৭০টি বোয়াল মাছের পোনা সংগ্রহ করে তা চাষ করেন তিনি। অন্য মাছের খাবারও বোয়াল মাছ খায়। এ ছাড়া সস্তায় কিছু পোনা মাছ কিনে এনে বোয়ালের খাদ্য হিসেবে পুকুরে ছেড়ে দেন তিনি। এগুলো খেয়ে বেড়ে ওঠে বোয়াল মাছ।
শহীদুল জানা, গত আট মাসে তার পুকুরের প্রতিটি বোয়াল মাছ চার থেকে পাঁচ কেজি ওজনের হয়েছে। আকার-আকৃতিভেদে প্রতিটি বোয়াল মাছ ৬০০ টাকা কেজি দরে পুকুর থেকে পাইকার ও এলাকার লোকজন কিনে নিয়ে যায়। এ বছর তিনি বোয়াল মাছ বিক্রি করেছেন ৯ লাখ ৬০ হাজার টাকার।
বাণিজ্যিকভাবে বোয়াল চাষ নিয়ে শহীদুল বলেন, ‘আমি একটি পুকুরে বোয়াল চাষ করেছি। এ বছর পুকুর বৃদ্ধি করব। তবে বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় বোয়ালের পোনা সংগ্রহ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। আমি খোঁজখবর রাখছি কোথায় বোয়ালের পোনা পাওয়া যায়। সেসব জায়গা থেকে বোয়ালের পোনা সংগ্রহের চেষ্টা আছে।’
শহীদুলের পুকুর থেকে মাছ কিনতে আসা ওবায়দুল হোসেন বলেন, ‘এ বছর শহীদুল ভাই বোয়াল চাষ শুরু করেছেন। আমি মাছ ব্যবসায়ী। ৬০০ টাকা কেজি দরে বোয়াল মাছ কিনে হাটে ৭০০ বা ৮০০ টাকা দরে বিক্রি করি। হাটে বোয়াল মাছের চাহিদা বেশ। শহর থেকে প্রাইভেট কার নিয়ে ক্রেতারা মাছ কিনতে আসেন। কেউ কেউ ফোনে অর্ডার করেন।’
ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা জয় বণিক বলেন, ‘বোয়াল একটি বিপন্ন প্রজাতির মাছে। খাল, বিল ও জলাশয়গুলো নষ্ট হওয়ায় এই মাছ এখন খুব একটা দেখা যায় না। শহীদুলের উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই। বোয়ালসহ অন্যান্য যে বিপন্ন প্রজাতির মাছ আছে, সেসব চাষে আমাদের পক্ষ থেকে যে ধরনের সহযোগিতা লাগবে আমরা তা দেব। আমরা চাই মৎস্য চাষি শহীদুল ইসলামের মতো অন্য চাষিরাও দেশীয় অন্যান্য মাছের সঙ্গে বিপন্ন মাছ চাষে আগ্রহী হোক। আমরা তাদের পাশে থাকব।’