পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড পরিচালিত ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় টেকসই সামাজিক সেবা প্রদান’ প্রকল্পটির মেয়াদ ২০২৩ সালের ৩০ জুন শেষ হচ্ছে। এরপর প্রকল্পের আওতায় পরিচালিত পাড়াকেন্দ্রের পাড়াকর্মী, অত্যাবশ্যকীয় জনবল, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর ভাগ্যে কী হবে– এ নিয়ে তারা বিপাকে পড়েছেন।
প্রকল্পটি স্থায়ী করতে চান পার্বত্য অঞ্চলের মানুষ। এটি চালু রাখা হলে পার্বত্য অঞ্চলের প্রত্যন্ত এলাকার মানুষ ধীরে ধীরে উন্নয়নের ধারায় যুক্ত হতে পারবে বলে তারা আশা করছেন। মেয়াদ বাড়ানো না হলে পার্বত্য অঞ্চলে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা ভেঙে পড়বে বলে তারা মনে করেন।
এটির দ্বিতীয় পর্যায়ে মেয়াদ বাড়ানোর জন্য উন্নয়ন বোর্ডের কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ ইয়াছিনুল হক।
পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড সুত্রে জানা যায়, প্রকল্পটিতে পাঁচ বছরে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৭৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এই প্রকল্পে সরকারি বরাদ্দ ৩৫০ কোটি ৮৭ লাখ টাকা এবং দাতা সংস্থা ইউনিসেফ থেকে ১২৩ কোটি ৬৩ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে।
এর মধ্যে পাড়াকর্মী ও মাঠ সংগঠকদের সম্মানীর পেছনে প্রতি মাসে খরচ ৪ কোটি ১২ লাখ টাকা; ২৩৯ জন কর্মকর্তার বেতন বাবদ প্রতি মাসে ব্যয় ৬২ লাখ টাকা।
২০১৮ সালের ১ এপ্রিল প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হয়। ২০২৩ সালের ৩০ জুন এর মেয়াদ শেষ হবে। তখন এর আওতায় পরিচালিত ৪ হাজার ৮০০ পাড়াকেন্দ্রে নিযুক্ত ৪ হাজার ৮০০ পাড়াকর্মী, ২৩৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী বেকার হয়ে পড়বে। অর্থনৈতিক ঝুঁকিতে পড়বে নিবেদিত হয়ে কাজ করা মানুষগুলো।
প্রকল্পসূত্রে জানা গেছে, আশির দশকের শুরুর দিকে বাংলাদেশ সরকার ও ইউনিসেফের যৌথ উদ্যোগে পার্বত্য অঞ্চলের মা ও শিশুদের কল্যাণের জন্য সেবামুলক কর্মসুচি গ্রহণ করা হয়। এই জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, বৃত্তিমুলক প্রশিক্ষণ, আত্ম-কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে আয়বৃদ্ধি এবং শিক্ষার হার সম্প্রসারণ ছিল প্রধান লক্ষ্য।
নব্বই দশকের শেষের দিকে ‘সমন্বিত সমাজ উন্নয়ন প্রকল্প দ্বিতীয় পর্যায়’ নাম দিয়ে ২৫ থেকে ৫০টি পরিবারের জন্য একটি পাড়াকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে সামাজিক সেবা প্রদান কার্যক্রম চালু রাখা হয়।
ওই নামে প্রকল্পটি ২০১১ সাল পর্যন্ত চলে। প্রকল্পের আওতায় তিন পার্বত্য জেলার ২৫টি উপজেলায় ৩ হাজার ৫০০টি পাড়াকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রতিটি পাড়াকেন্দ্রে একজন পাড়াকর্মী নিয়োগ দিয়ে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মা ও শিশুদের টিকা নিতে উদ্বুদ্ধ করা, বিশুদ্ধ পানি পান, গর্ভ ও প্রসবকালীন সেবা ও পরামর্শ দেয়া, স্বাস্থ্যসম্মত পয়ঃব্যবস্থাপনা, জন্ম নিবন্ধন, কম্যুনিটির সক্ষমতা বাড়ানো, কিশোর-কিশোরী উন্নয়ন এসব বিষয়ে স্থানীয় জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করা হয়।
২০১২ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় সমন্বিত সমাজ উন্নয়ন প্রকল্প তৃতীয় পর্যায় নাম দিয়ে আগের কার্যক্রমই চালু রাখা হয়। ২০১৭ সাল পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়।
ওই সময় প্রকল্পে আরও অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায়। পার্বত্য তিন জেলার ১১৮টি ইউনিয়নের ৩ হাজার ৬১৬টি গ্রামে ১ লাখ ৬০ হাজার পরিবারের মধ্যে মৌলিক সেবা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেয়া হয়। পাড়াকেন্দ্রগুলোকে সব ধরনের মৌলিক সেবা বিতরণের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা অব্যাহত রাখা হয়।
২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাঙ্গামাটির কাপ্তাই উপজেলায় নির্মিত ৪ হাজারতম পাড়াকেন্দ্রটির উদ্বোধন করেছিলেন।
এখন এই প্রকল্পের মেয়াদ শেষের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, এর সঙ্গে জড়িতদের দুশ্চিন্তাও বাড়ছে।
এসব বিষয়ে কথা হয় বরকল উপজেলার সুবলং ইউনিয়নের তন্ন্যছড়ি (২) মডেল পাড়াকেন্দ্রের পাড়াকর্মী পহেলী চাকমা সঙ্গে।
তিনি বলেন, ‘শুনেছি ২০২৩ সালের জুন মাসে প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হচ্ছে। তথ্যটি শোনার পর থেকে চিন্তা করছি পাড়াকেন্দ্রে পড়ুয়া শিশুদের ভবিষ্যত নিয়ে। কারণ পাড়াকেন্দ্রে এসে তারা যে শিক্ষাগুলো পায় তা প্রাথমিকে গেলে তা পায় না।
‘শিক্ষার পাশাপাশি পাড়াকেন্দ্রে গান, ছড়া ও কবিতা আবৃত্তি, নানা রকম খেলাধুলায় মাতিয়ে রাখা হয় শিশুদের। এ ছাড়া বর্ণমালা পরিচিতি, সংখ্যা শেখানো, সহজ শব্দ গঠনও শিখতে পারে শিশুরা। উঠান বৈঠকের মাধ্যমে গর্ভবতী মা, প্রসুতি মা ও কিশোর-কিশোরীদের মাঝে স্বাস্থ্য বিষয়ক পরামর্শ দেয়া হয়।’
সদর উপজেলার বন্দুক ভাঙ্গা ইউনিয়নের কুমড়া পাড়া কেন্দ্রের পাড়াকর্মী জিতা চাকমা বলেন, ‘প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলে পাড়াকেন্দ্রে যে শিশুরা পড়াশোনা করে, তারা আর শিখতে পারবে না। পাড়াকেন্দ্রে পড়তে এসে তাদের মানসিক বিকাশ ঘটে। তিন থেকে পাঁচ বছরের শিশুরা পাড়াকেন্দ্রে পড়ার সুযোগ হওয়াতেই প্রাথমিকে গেলে তারা সহজে সবকিছু আয়ত্তে আনতে পারে।’
অন্যদিকে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পের কার্যক্রম চালু রাখতে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে একটি স্বতন্ত্র শাখা চালু এবং অত্যাবশ্যকীয় সম্পদ ও জনবল রাজস্বখাতে আনার প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত ৮৫ কোটি টাকার বার্ষিক বরাদ্দ দেয়ার একটি সুপারিশ পরিকল্পনা কমিশন দিয়েছে। কিন্তু বোর্ড কর্তৃপক্ষ এখনও মন্ত্রণালয়ে কোনো প্রস্তাব পাঠায়নি বা কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
টেকসই সামাজিক সেবা প্রদান প্রকল্পের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ ইয়াছিনুল হক বলেন, ‘প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়ানোর জন্য দ্বিতীয় পর্যায়ে কাজ চালাচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড। প্রকল্পের কার্যক্রম অব্যাহত রাখার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পরামর্শ অনুযায়ী নতুন ডিপিপি প্রণয়নের কাজ চলছে। আশা রাখি প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়তে পারে।’
এই প্রকল্পের স্থায়িত্ব সবাই চায় বলে মন্তব্য করছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা।
তিনি বলেন, ‘প্রকল্পটি পার্বত্য অঞ্চলের প্রত্যন্ত এলাকার জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা, পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টির উন্নয়ন, নারী ও শিশুদের কল্যাণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে।
‘প্রত্যন্ত অঞ্চলের জন্য এটি একটি জনবান্ধব প্রকল্প। পাড়াকর্মী, মাঠ সংগঠক, কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও নিরলসভাবে দক্ষতা আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন।’