বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

পার্সেলের ফাঁদ: কুলি থেকে কোটিপতি

  •    
  • ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ২২:৪০

দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলা, লেনদেনসহ সামগ্রিক কাজ দেখভাল করেন বিপ্লব লস্কর নামে এক যুবক। গোপালগঞ্জের বাসিন্দা বিপ্লব ও তার পরিবার কুলির কাজ করলেও পার্সেল প্রতারণার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর এখন তিনি কোটি কোটি টাকার মালিক।

অল্প কয়েক দিনের পরিচিত বিদেশি বন্ধুর উপহার পেতে কাস্টমস ফির নামে টাকা দিলেন তো ফাঁদে পড়লেন। একবার ফাঁদে পড়লে যেন এর শেষ নেই। প্রতি ধাপেই বাড়ে মোটা অঙ্কের টাকা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেই অঙ্ক গিয়ে ঠেকে ৩০ লাখের উপরে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচয় হওয়া বিদেশি বন্ধুর পাঠানো পার্সেল কাস্টমস থেকে উঠাতে গিয়ে সম্প্রতি ৩২ লাখ টাকা খুইয়েছেন এক ব্যক্তি। শত শত মানুষ পড়ছেন পার্সেলের ফাঁদে। বিদেশিদের সঙ্গে দেশীয়রা মিলে এই চক্র গড়ে তুলেছে।

চক্রের সদস্যরা লেনদেন করেন ব্যাংকের মাধ্যমে। যে কারণে ভুক্তভোগীরাও সহজে বিশ্বাস করেন। দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলা, লেনদেনসহ সামগ্রিক কাজ দেখভাল করেন বিপ্লব লস্কর নামে এক যুবক। গোপালগঞ্জের বাসিন্দা বিপ্লব ও তার পরিবার কুলির কাজ করলেও পার্সেল প্রতারণার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর এখন তিনি কোটি কোটি টাকার মালিক।

সোমবার রাতে রাজধানীর মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে পার্সেল চক্রের বাংলাদেশপ্রধান বিপ্লব লস্করসহ ১১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) এর গোয়েন্দা সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ।

গ্রেপ্তার অন্যরা হলেন- বিপ্লবের প্রধান সহযোগী সুমন হোসেন ওরফে ইমরান, মোহসিন হোসেন ওরফে শাওন, ইমরান হাসান ওরফে ইকবাল, নাজমুল হক রনি ও মোসা. নুসরাত জাহান।

এছাড়া গ্রেপ্তার করা হয়েছে নাইজেরিয়ান নাগরিক চিডি, ইমানুয়েল, জন; আঙ্গোলিনার নাগরিক উইলসন ডে কনসিকাউ, ক্যামেরুনের নাগরিক গুলগ্নি পাপিনিকে।

গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে ১টি বিদেশি পিস্তল, ২ রাউন্ড গুলি, ১টি ম্যাগজিন, ২৮টি মোবাইল ফোন, ১ টি কম্পিউটার, ৪৯১ টি এটিএম কার্ড, ২৬টি চেক বই, ১ হাজার ৪১৫টি চেকের পাতা, ৩টি ওয়্যারলেস পকেট রাউটার, ১ টি প্রাইভেটকার, সাড়ে ৩ লাখ জাল টাকা, ১১ লাখ ৩৫ হাজার নগদ টাকা, প্রতারণা সম্পর্কিত কথোপকথনের অসংখ্য স্ক্রিনশট ও বিভিন্ন মোবাইল অপারেটরের ২৬৩ টি সিম কার্ড উদ্ধার করা হয়।

মঙ্গলবার দুপুরে ডিএমপির গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ সংবাদ সম্মেলন করেছেন।

যেভাবে পাতা হয় ফাঁদগোয়েন্দা পুলিশ জানিয়েছে, বিদেশি নাগরিকের আইডি থেকে প্রথমে টার্গেট করা ব্যক্তির সঙ্গে সামাজিক যোগাাযোগ মাধ্যমে সম্পর্ক তৈরি করা হয়। একটা সময় পর্যন্ত কনভারসেশন চালিয়ে যায়। এক পর্যায়ে টার্গেট করা ব্যক্তিকে উপহার পাঠায় বিদেশি নাগরিক। পার্সেল আকারে পাঠানো উপহার বক্সের ছবিও পাঠানো হয়।

এক বা দুদিন পর টার্গেট করার ব্যক্তির কাছে বাংলাদেশি নাম্বার থেকে কল যায়। যা কল সেন্টারের মতো করে পরিচালনা করে প্রতারকরা। বলা হয়, আপনার নামে একটি পার্সেল এসেছি। পার্সেলটি নেয়ার জন্য ট্যাক্স হিসেবে কিছু টাকা দিতে হবে। ট্যাক্স হিসেবে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট দুই-তিন হাজার টাকা দেয়ার কথা বলা হয়। প্রথমে টাকার অঙ্ক কম বলে, যাতে বিশ্বাস করতে সুবিধা হয়। বিশ্বস্ততা বাড়াতে ব্যবহার করা হয় দেশের বিভিন্ন ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট। একবার টাকা পাঠালেই ফাঁদের মাত্রা বাড়তে থাকে। খুইতে হয় আরও বেশি পরিমাণে টাকা।

ধাপে ধাপে বাড়ে টাকাধাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দাবি করার টাকার পরিমাণও বাড়তে থাকে। প্রথম ফাঁদে পা দিয়ে টাকা পাঠানোর পর কিছুটা সময় নিয়ে আবার টার্গেট করা ব্যক্তিকে কল দেয়। তখন বলা হয়, পার্সেলটি স্ক্যান করার সময় ভেতরে মূল্যবান জিনিস পাওয়া গেছে। সোনাসহ অন্যান্য মূলবান ডিভাইসের জন্য আলাদা ট্যাক্স দেয়া লাগবে। অনেক মূলবান জিনিসের জন্য ট্যাক্সের হারটাও বাড়ানো হয়, যা লাখের কোটায় যায়।

ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ তারেক বিন রশিদ নিউজবাংলাকে বলেন, পার্সেলের ফাঁদটি মূলত লোভের ফাঁদ। একবার ফাঁদে যিনি পড়েন তিনি মূল্যবান জিনিসের লোভে ধাপে ধাপে টাকা দিতে থাকেন। যখন গিয়ে প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পারেন ততক্ষণে প্রতারকরা টার্গেট করার ব্যক্তির সঙ্গে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়।

নাম ভাঙানো হয় সাংবাদিক ও পুলিশেরদ্বিতীয় ধাপে টাকা দেয়ার পর তৃতীয় ধাপের জন্য নতুন ফাঁদ ফেলে পার্সেল প্রতারকরা।

ডিবি কর্মকর্তা তারেক বিন রশিদ জানান, তৃতীয় ধাপে টার্গেট করা ব্যক্তিকে বলা হয়, আপনার যে পার্সেলটি এসেছে তাতে অনেক মূল্যবান টাকা থাকায় জিনিস থাকায় বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেছে। সাংবাদিক ও পুলিশ জেনে গেছে। তাদের ম্যানেজ করতে হবে। এজন্য আরও টাকা দিতে হবে।

মোহাম্মদ তারেক বিন রশিদ বলেন, ‘আগের দুই ধাপে যিনি টাকা দিয়েছেন তিনি লোভের পাশাপাশি দুই দফায় টাকা দেয়ার ফাঁদেও পড়েন। কারণ তিনি ইতোমধ্যে কয়েক লাখ টাকা দিয়েছেন। আর কিছু টাকা না দিলে পুরোটাই লস হবে এই ভেবে আবারও টাকা দেন। একটা পর্যায় পর্যন্ত বিভিন্ন অজুহাতে টাকা নিতে থাকেন। এক সময় টার্গেট করা ব্যক্তির সন্দেহ হয়। যতক্ষণে প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পারেন তার আগেই প্রতারকরা সব যোগাযোগ বন্ধ করে লাপাত্তা হয়ে যান।’

ব্যাংকের লোকজন জড়িত থাকার সন্দেহপার্সেল প্রতারণায় প্রতারক চক্রটি দেশের বিভিন্ন ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিত। ১১ জনকে গ্রেপ্তারের পর তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানতে পেরেছে, চক্রের বাংলাদেশ প্রধান বিপ্লব লস্করের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এক হাজারের বেশি ব্যাংক আকাউন্ট। যেগুলো নামে-বেনামে খোলা হয়েছে। টার্গেট করা ব্যক্তির কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতেই লেনদেনগুলো ব্যাংকিং চ্যানেলে করা হতো।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ডিবি কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা তাদের কাছে ৪৯১ টি এটিএম কার্ড পেয়েছি। বিপ্লবের নিয়ন্ত্রণে এক হাজারের বেশি অ্যাকাউন্ট থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। সাধারণ একজন গ্রাহকের তুলনায় বিপ্লব ও তার সহযোগীরা অ্যাকাউন্ট খোলার ক্ষেত্রে সুবিধা পেয়ে আসছিল বলে মনে হয়েছে। আমরা তদন্ত করে দেখছি, ব্যাংকের কেউ জড়িত আছে কিনা।’

বিপ্লব লস্কর কুলি থেকে কোটিপতিডিবি তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, বিপ্লব লস্কর ও তার পরিবারের সদস্যরা এক সময় গোপালগঞ্জে কুলি হিসেবে কাজ করতেন। ২০০০ সালে বিপ্লব ঢাকা আসেন। একসময় গার্মেন্টেসের কাপড় কিনে বিক্রি করতেন। সেখানেই নাইজেরিয়ানদের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। ২০০৭ সাল থেকে পার্সেল প্রতারণা শুরু করেন।

গোয়েন্দারা বিপ্লবের একটি বাড়ির সন্ধান পেয়েছেন, যা পূর্বাচলের পাশে ইছাপুরে। তার নামে থাকা ডুপ্লেক্স এই বাড়িটি বর্তমান বাজারমূল্য ৫ কোটি টাকার বেশি। নিজের নামে করা সম্পদের তুলনায় স্বজন ও অন্যদের নামে বিপ্লব বেশি সম্পদ কিনেছেন। কোথায় কোথায় তার আরও সম্পদ রয়েছে সেগুলোও গোয়েন্দারা খোঁজ করছেন।

এ বিভাগের আরো খবর