এবারও হলো না তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি। তবে ভারতের সরকার প্রধান নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে আলোচনা শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, কুশিয়ারার সমস্যার সমাধান করেছেন তারা। তিস্তাও করে ফেলবেন।
ভারত সফরের দ্বিতীয় দিন মঙ্গলবার নয়াদিল্লির হায়দারাবাদ হাউজে মোদীর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ এ আশার কথা বলেন বাংলাদেশের সরকার প্রধান।
এই সফরে ভারতের সঙ্গে মোট সাতটি সমঝোতা হলেও বাংলাদেশের বহুল প্রতীক্ষিত তিস্তার জট খোলেনি। যে চুক্তি ২০১১ সালে দেশটির সরকার প্রধান মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরেই হওয়ার কথা ছিল, সেটি আরও ১১ বছরেও দেখল না আলোর মুখ।
আওয়ামী লীগের গত মেয়াদের মাঝামাঝি সময়ে ২০১৭ সালে শেখ হাসিনা যখন ভারতে রাষ্ট্রীয় সফরে যান, তখন মোদি বলেছিলেন বাংলাদেশে শেখ হাসিনা ও তার সরকারের মেয়াদেই তিস্তা চুক্তি হবে। কিন্তু ওই সরকারের মেয়াদ শেষে এই চুক্তি হয়নি। আর এবারের সফরে যে তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না, সেটি আগে থেকেই অনুমিত ছিল।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নয়াদিল্লির হায়দ্রাবাদ হাউজে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে দিপাক্ষিক বৈঠক করেন। ছবি: পিআইডি
শেখ হাসিনা অবশ্য আশাবাদী। তিনি বলেন, ‘আমরা বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে অনেক অনিষ্পন্ন সমস্যার সমাধান ইতোমধ্যে করেছি। আমি আশা করি তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তিসহ অন্যান্য অনিষ্পন্ন বিষয়গুলো শিগগির করতে পারব।’
তিনি বলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রী মোদীকে ধন্যবাদ জানাই, আজকে আমরা কুশিয়ারা ইস্যু সমাধান করেছি এবং আমি আশাবাদী, মোট যে ৫৪টি নদী আছে, সেগুলো… আমি জানি, যতক্ষণ পর্যন্ত মোদি আছেন, বাংলাদেশ-ভারত আমরা সব সমস্যার সমাধান করে ফেলব।’
২০১১ সালে যার বিরোধিতায় শেষ পর্যায়ে এসে তিস্তা চুক্তি আটকে যায়, সেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় এবার শেখ হাসিনার ভারত সফরে নয়াদিল্লিতে আমন্ত্রণই পাননি।
শেখ হাসিনার এবারের সফরে সিলেটের কুশিয়ারা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। গত আগস্টে দুই দেশের যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে এই সমঝোতার খুঁটিনাটি চূড়ান্ত হয়।
সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা বলেন, ‘৫৪টি অভিন্ন নদী এবং চার হাজার কিলোমিটার সীমান্ত বেষ্টিত বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশ তাদের জনগণের সম্মিলিত কল্যাণে বদ্ধপরিকর।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নয়াদিল্লির হায়দ্রাবাদ হাউজে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে বৈঠক। ছবি: পিআইডি
বাংলাদেশ ও ভারত অংশীদার হিসেবে একসঙ্গে কাজ করতে পারলে কেবল তা দুই দেশের জন্যই নয়, বরং পুরো অঞ্চলে শান্তি ও সমৃদ্ধি বয়ে আনবে বলেও মনে করেন তিনি। বলেন, ‘যদি বাংলাদেশ এবং ভারত অংশীদার হিসেবে একসঙ্গে কাজ করতে পারে, তবে তা শুধু দুই দেশের জন্যই নয়, সমগ্র অঞ্চলে শান্তি ও সমৃদ্ধি বয়ে আনবে।’
যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার সীমান্ত দিয়ে ৫৪টি নদী প্রবাহিত হয়। এসব নদী উভয় দেশের মানুষের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে যুক্ত। আজ আমরা কুশিয়ারা নদীর পানিবণ্টন সংক্রান্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষর করেছি।
‘ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্য দ্রুত বাড়ছে। আমরা আইটি, মহাকাশ এবং পারমাণবিক খাতে সহযোগিতা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নিয়েও ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে আলোচনা চলছে।’
ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গার্ড অব অনার পরিদর্শন করেন। ছবি: পিআইডি
আর যা নিয়ে আলোচনা
মোদির সঙ্গে আলোচনা নিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্য দ্রুত বাড়ছে। আমরা আইটি, মহাকাশ এবং পারমাণবিক খাতে সহযোগিতা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নিয়েও ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে আলোচনা চলছে।’
ভারতের স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকী উপলক্ষে সারা বছরব্যাপী আয়োজিত ‘আজাদি কা অমৃত মহোৎসব’-এর সফল সমাপ্তির জন্য ভারতকে অভিনন্দন জানান প্রধানমন্ত্রী।
দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় বৈঠককে আরেকটি ‘ফলপ্রসূ আলোচনা’ উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, এই বৈঠকের ফলাফল দুই দেশের জনগণকে উপকৃত করবে।
তিনি বলেন, ‘ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার চেতনা নিয়ে আমরা বৈঠকটি করেছি। সামনের দিনগুলোতে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় ইস্যুগুলো আরও সামনে এগিয়ে নিতে বৈঠকে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করেছি।’
পারস্পরিক স্বার্থে দুই দেশের মধ্যকার প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়ন এবং পারস্পরিক অগ্রাধিকারগুলোকে গুরুত্ব দেয়ার বিষয়ে বৈঠকে আলোচনা হয় বলে জানান শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, ‘কানেকটিভিটি, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তা, সীমান্ত এবং ঋণসুবিধার ক্ষেত্রগুলো নিয়ে আলোচনা হয়।’
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারত সরকার ও জনগণের অমূল্য ত্যাগের কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে বাংলাদেশ-ভারত ইতিহাস, সংস্কৃতি, পারস্পরিক আস্থা ও সম্মান, দীর্ঘস্থায়ী বন্ধুত্ব এবং অব্যাহত সহযোগিতামূলক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে।’
নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বের প্রশংসা করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এটি আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও গতি প্রদান করেছে।’
অন্যদিকে মোদি বলেন, ‘বন্ধুপ্রতিম ভারত সবসময়ই বাংলাদেশের উন্নয়ন চায়। বাংলাদেশ ভারতের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী এবং চতুর্থ রপ্তানি বাজার। তাই বাংলাদেশের উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতা সবসময়ই চায় ভারত।’
তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ দ্রুত উন্নয়নের সাক্ষী হয়েছে। ঢাকা এই অঞ্চলে দিল্লির সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার এবং আমাদের শক্তিশালী সাংস্কৃতিক সম্পর্ক রয়েছে। গত কয়েক বছরে আমাদের পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আমি বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে আলোচনা করেছি। আমাদের কোভিড মহামারি, সাম্প্রতিক বৈশ্বিক ঘটনাপ্রবাহ থেকে শিক্ষা নিতে হবে এবং আমাদের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে হবে।’
শেখ হাসিনার দ্বিতীয় দিনের কর্মসূচি
মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার পর হায়দরাবাদ হাউসে আসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে তাকে অভ্যর্থনা জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
ফটোসেশনে অংশগ্রহণের পর দুই প্রধানমন্ত্রী রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসেন। একান্ত বৈঠকের পর দুই দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক করেন দুই প্রধানমন্ত্রী।
এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সম্মানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দেওয়া মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেন।
বিকেলে দিল্লিতে রাষ্ট্রপতি ভবনে ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর সঙ্গে বৈঠক করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে উপরাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখরের সঙ্গে বৈঠক করেন।
সকালে দিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আনুষ্ঠানিকভাবে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তারপর প্রধানমন্ত্রী ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীর সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
এর আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একটি ভিভিআইপি ফ্লাইটে চার দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে সোমবার নয়াদিল্লিতে যান প্রধানমন্ত্রী। সফর শেষে আগামী ৮ সেপ্টেম্বর ঢাকায় ফিরবেন তিনি।