বরগুনা ও নারায়ণগঞ্জ- দুই জায়গাতেই পুলিশের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত বল প্রয়োগের অভিযোগ উঠার পর একটি ঘটনায় বাহিনীটি তৎপরতা দেখালেও আরেকটি ঘটনায় একেবারে চোখ বুঁজে।
বরগুনায় এই ‘অতিরিক্ত বল প্রয়োগের’ শিকার হয়েছিলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জে এর শিকার হন বিএনপি ও তার সগযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা।
বরগুনায় বেধরক পেটানো হয়েছে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের। অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জে সংঘর্ষের সময় এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা অন্যের রাইফেল হাতে তুলে নিয়ে নেতা-কর্মীদের দিকে সরাসরি একের পর এক গুলি করেছেন। এতে একজনের প্রাণহানিতে তেঁতে উঠেছে রাজনৈতিক অঙ্গন।
বরগুনায় ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের পুলিশের বেধরক মারধরের পর তুমুল সমালোচনার মুখে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রত্যাহার হয়ে যান জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মহররম আলী। প্রথমে বরিশাল ও পরে পাঠানো হয় চট্টগ্রামে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের নির্দেশে পুলিশ এই ঘটনার তদন্ত করে ১৯ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
কিন্তু নারায়ণগঞ্জে গোয়েন্দা কর্মকর্তার গুলির পাঁচ দিনেও নেয়া হয়নি তদন্তের কোনো উদ্যোগ। প্রশ্ন উঠেছে, বিএনপির নেতা-কর্মীরা আক্রান্ত বলেই পুলিশ নিস্পৃহ কিনা।
নারায়ণগঞ্জের গুলি করার মতো পরিস্থিতি ছিল কি?
গত বৃহস্পতিবার বিএনপির ৪৪ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিন দলটির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। বিএনপি থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, গোয়েন্দা বাহিনীর উপপরিদর্শক মাহফুজুর রহমান কনকের ছোড়া গুলিতেই মৃত্যু হয়েছে কাদের সংগঠনের কর্মীর। কনক গুলি করেছিলেন যে চায়নিজ রাইফেল দিয়ে, সেটি সাধারণ রাজনৈতিক কর্মসূচিতে ব্যবহার হয় না।
বিএনপি এমনও দাবি করেছে, সেখানে সরাসরি বুলেট ব্যবহারের মতো কোনো পরিস্থিতিই ছিল না। তার পরেও কার নির্দেশে এই ঘটনাটি ঘটানো হয়েছে সেটি জানতে চান নেতারা।
শাওন যে সংগঠনের কর্মী ছিলেন সেই যুবদলের নারায়ণগঞ্জ শাখার সদস্যসচিব মশিউর রহমান রনি বলেন, ‘আমাদের শান্তিপূর্ণ মিছিলে পুলিশ কার নির্দেশে গুলি করেছে, আমরা তা জানতে চাই। আমাদের কর্মীকে গুলি করে মারা হলো, আবার আমাদের নামে মামলা করে আমাদের ঘরছাড়া করলেন। এটি কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে হতে পারে না।’
১ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জে পুলিশের গুলি করার দৃশ্য
মহানগর বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি সাখাওয়াত হোসেন খাঁন বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের এ ধরনের ঘটনা আগে ঘটেনি। এখন কেন ঘটল? ঘটনার পাঁচ দিন পার হলো, কিন্তু পুলিশ যে গুলি করল, তা নিয়ে তদন্ত হলো না কেন?
নারায়ণগঞ্জ পুলিশের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, সেদিন কনক গুলি করেছিলেন চায়নিজ এসএমজি সেভেন পয়েন্ট সিক্স টু রাইফেল দিয়ে। বড় ধরনের কোনো সংঘাত হলে ব্যবহার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
কিন্তু নারায়ণগঞ্জে বিএনপির নেতা-কর্মীরা পুলিশের দিকে যে ইট পাটকেল ছুঁড়ছিলেন, তাকে বড় সংঘাত বলা যায় কি না, এ নিয়ে প্রশ্ন আছে।
নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আমির খসরু সেদিন গুলি করার পক্ষে যুক্তি দিয়ে তিনি বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জে প্রথমে কী পরিস্থিতি ছিল তা সকলে দেখেছে। বরগুনা ও নারায়ণগঞ্জের দুটি দুই রকম প্রেক্ষাপট। আমরা প্রায় এক ঘণ্টা পর সেখানে গিয়েছি। তখনও দেখেছি পুলিশ বক্সের ভেতরে ইটপাটকেল, বিএনপি নেতাকর্মীরা সড়কে। তাদের হামলায় আমাদের ২০ জন পুলিশ সদস্য আহত। এই পরিস্থিতিতে পুলিশ রাবার বুলেট ও টিয়ারশেল ছুড়তে পারে।’
তাহলে রাইফেল দিয়ে গুলি করার বিষয়টি তদন্তের আওতায় আনা হবে না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘বিষয়গুলো পর্যালোচনা করা হচ্ছে। একটি তদন্ত তো হবেই। তবে কখন এ তদন্ত শুরু হবে তার সিদ্ধান্ত জানাবেন পুলিশ সুপার।’
তবে গুলি করার অনুমতি কে দিয়েছে, তা জানেন না বলে দাবি করেন আমির খসরু।
সেখানে গুলির পরিস্থিত হয়েছিল কি না- এ প্রশ্নের উত্তর জানতে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেলের মোবাইল ফোনে একাধিক নম্বর দিয়ে অন্তত ১০ বার কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
বিএনপির নেতা-কর্মীদের দিকে ছুড়তে রাইফেলে গুলি ভরছেন নারায়ণগঞ্জ গোয়েন্দা বাহিনীর উপপরিদর্শক মাহফুজুর রহমান কনক
মানবাধিকার কমিশনের নারায়ণগঞ্জের সভাপতি মাহাবুবুর রহমান মাসুম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিএনপি মিছিল বের করেছে, পুলিশ লাঠিপেটা করল, এটা সহনীয় ছিল। কিন্তু সেখানে একাধারে গুলি করা হলো, একটা ছেলে মারা গেলে। এটি আমার ভাষায় একটি হত্যা। এখানে যে চাইনিজ রাইফেল ব্যবহার করা হয়েছে সেটি দিয়ে গুলি করার অনুমতি দিল কে? এখানে গুলি করার মতো পরিস্থিতি শুরুতে ছিল না। পুলিশ পুরো বিষয়টি ঘোলাটে করেছে।’
নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সভাপতি এ বি সিদ্দিক বলেন, ‘আমার কথা হলো এমনভাবে গুলি করল যে, একটা ছেলেকে মেরেই ফেলা হলো। আমরা দাবি জানাচ্ছি, যার গুলিতে ওই যুবক নিহত হয়েছে তাকে খোঁজে বের করা হোক। তাকে শাস্তির আওতায় আনা হোক। তদন্ত করা হোক সেখানে গুলি করার পরিস্থিতি ছিল কি না।
‘কে গুলি করার নির্দেশ দিয়েছে? নারায়ণগঞ্জে কে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করল-এগুলো খতিয়ে দেখা হোক। গণতান্ত্রিক দেশে এগুলো আশা যায় না।’
বরগুনায় কী হয়েছিল
১৫ আগস্ট জাতীয় শোকদিবসে জেলায় বঙ্গবন্ধু স্মৃতি কমপ্লেক্সে তার প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে ফেরার সময় শিল্পকলা অ্যাকাডেমির সামনে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ওপর পদবঞ্চিত কয়েকজন হামলা চালায়। এ সময় দুই পক্ষের নেতাকর্মীরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। সংঘর্ষের মধ্যেই পুলিশ ছাত্রলীগের কর্মীদের বেধড়ক মারধর করে।
সেদিন কমপ্লেক্সে ঢুকে এবং কমপ্লেক্স থেকে নেতা-কর্মীরা যখন দৌড়ে বের হন, তখন পুলিশ পিটিয়েছে নির্বিচারে। জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মহররম আলী তর্কাতর্কিতে জড়ান সদর আসনের সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর সঙ্গে।
এই দুটি ঘটনার ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হলে ঘটনার পরদিন ঢাকায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, ‘বরগুনার ঘটনায় বাড়াবাড়ি করেছে। এটা কেন হলো আইজিপিকে বলা হয়েছে, ব্যবস্থা নিতে। তদন্ত হয়ে আসুক। আমার কাছে মনে হয়েছে, এতটা বাড়াবাড়ি ঠিক হয়নি। এটা ঘটানো উচিত হয়নি।’
গত ১৫ আগস্ট বরগুনায় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের পিটুনির দিন স্থানীয় সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর সঙ্গে তর্কাতর্কিতে জড়ান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মহররম আলী। পরদিন তাকে প্রত্যাহার করে প্রথমে বরিশাল ও পরে চট্টগ্রাম পাঠানো হয়। ব্যবস্থা নেয়া হয় আরও ১৮ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে
তিনি এই বক্তব্য দেয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ব্যবস্থা গ্রহণ হয়ে যায়। দুপুরেই বরগুনা থেকে প্রত্যাহার করে মহররম আলীকে বরিশাল রেঞ্জে বদলি করা হয়। পরদিন তাকে পাঠানো হয় চট্টগ্রামে।
সেদিন পুলিশ অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করেছে কি না, এই বিষয়টি তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেয়া হয় এক সপ্তাহেরও কম সময়ে। ২২ আগস্ট বরিশাল রেঞ্জের ডিআইজি এসএম আক্তারুজ্জামান জানান, তদন্ত প্রতিবেদনে মহররম আলীসহ ১৯ পুলিশের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়।
এই ১৮ জনের মধ্যে ছিলেন একজন পুলিশ পরিদর্শক, ছয়জন উপপরিদর্শক (এসআই), চারজন সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই), একজন নায়েক ও ছয়জন কনস্টেবল, যাদের বিরুদ্ধে প্রত্যাহার, বদলিসহ নানা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।