ভারতে চার দিনের রাষ্ট্রীয় সফরের দ্বিতীয় দিন মঙ্গলবার দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকে বসেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সফরসূচি অনুযায়ী দিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে স্থানীয় সময় বেলা ১১টা ৩৫ মিনিটে এ বৈঠক শুরু হয়।
দুই দফায় ১২টা ৫৫ মিনিট পর্যন্ত এ বৈঠক হবে। বৈঠকে একান্ত কথা বলবেন দুই সরকারপ্রধান। এ ছাড়া দুই প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে প্রতিনিধি পর্যায়েও আলোচনা হবে।
বহুল আকাঙ্ক্ষিত এ বৈঠকে বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি সহায়তা, নিত্যপণ্যের নিশ্চিত সরবরাহ, আরোপিত বাণিজ্যিক বাধা অপসারণ, আঞ্চলিক কানেকটিভিটি, বিবিআইএন কার্যকর, নেপাল ও ভুটানের জন্য বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহারের নিশ্চয়তা চাইতে পারে বলে জানিয়েছে কূটনৈতিক সূত্রগুলো। পাশাপাশি বাংলাদেশ পরিবর্তিত বিশ্বে কূটনীতি, ব্যাবসা-বাণিজ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তা ও রোহিঙ্গাদের ফেরাতে ভারতের জোর সহায়তা চাইতে পারে বলেও জানিয়েছে সূত্রগুলো।
অন্যদিকে ভারত চাইতে পারে যেকোনো মূল্যে বাংলাদেশকে চীনের বলয় থেকে রক্ষা করতে। এ জন্য সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ, যৌথ সমরাস্ত্র তৈরি কারখানা, পণ্য সরবরাহের গাইডলাইন তৈরি ও সমন্বিত বাণিজ্যিক কাঠামো বা সেপা চুক্তির ঘোষণা চাইতে পারে দেশটি।
বৈঠকে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে পানিসহ সব অমীমাংসিত সমস্যা সমাধান নিয়েও। তার আগেই ভারতকে ‘বিশ্বস্ত বন্ধু’ আখ্যা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সোমবার রাতে এক অনুষ্ঠানে তিনি আরও বলেন, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক রাজনীতির ঊর্ধ্বে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে ভারতের উদ্বৃত্ত জ্বালানি তেল আমদানি করার প্রস্তাব দেবে বাংলাদেশ।
ভারতের সঙ্গে জ্বালানিসহ জরুরি পণ্য সরবরাহ নিয়ে আলোচনার বিষয়ে সোমবার পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ ভারত থেকে যেসব কৌশলগত পণ্য আমদানি করে, সেগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে ভারত যাতে বাংলাদেশকে অবহিত করে, এ বিষয়টি মূল আলোচনায় থাকবে।
তিনি বলেন, জ্বালানি সংগ্রহের ক্ষেত্রে অনেক দেশ সমস্যায় পড়ছে। এ বিষয়টি নিয়েও আলোচনা করা হবে। ভারতের যদি উদ্বৃত্ত জ্বালানি থাকে, তা কীভাবে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সরবরাহ করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা হবে। এটি নিশ্চিত করা গেলে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে পারবে বাংলাদেশ।
রাশিয়া থেকে জ্বালানি ক্রয় নিয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘রাশিয়া থেকে জ্বালানি কেনা যাবে না, এটা ঠিক না, কিন্তু রাশিয়ার যে কারিগরি বিষয়গুলো রয়েছে, সেগুলো এখন যাচাই করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে কীভাবে এর মূল্য পরিশোধ করা হবে, তা খতিয়ে দেখার বিষয় রয়েছে।
‘ভারতের কাছে যদি উদ্বৃত্ত জ্বালানি থাকে, আর যদি সহজ শর্তে পাওয়া যায়, তাহলে এ জ্বালানি সংগ্রহের বিষয়টি অবশ্যই বাংলাদেশ বিবেচনা করবে।’
আরেকটি সূত্র বলছে, বাংলাদেশের কাছে পরিশোধিত ডিজেল রপ্তানি করতে চায় ভারত। এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। ভারতে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের পর এ বিষয়ে চূড়ান্ত ঘোষণা আসতে পারে।
এদিকে আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে বিবিআইএন (বাংলাদেশ, ভুটান, নেপাল, ভারত) মোটরযান চুক্তির দ্রুত বাস্তবায়নে বাংলাদেশ জোর দেবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, ‘ভারতও চাইছে এটি দ্রুত চালু হোক। উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার অংশ হিসেবে ভারত পশ্চিমবঙ্গের হিলি থেকে বাংলাদেশ হয়ে মেঘালয়ের মেহেন্দ্রগঞ্জ পর্যন্ত ইস্ট-ওয়েস্ট হাইওয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে সহযোগিতা চাইবে।’
কূটনৈতিক সূত্রে আরও জানা যায়, করোনাভাইরাস মহামারির সময় রেলে পণ্য পরিবহনের মাধ্যমে সরবরাহ ব্যবস্থা নিরবচ্ছিন্ন রাখা নিশ্চিত করেছিল ভারত। এরই ধারাবাহিকতায় ভারত প্রস্তাব দিয়েছে চাল, গম, পেঁয়াজসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় যেসব পণ্য বাংলাদেশ আমদানি করে, তার একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ আগাম জানাতে।
বাংলাদেশ নিজের চাহিদার কথা জানালে ভারত আগে থেকে সেটি বিবেচনায় নেবে। ফলে ভারত নিজের চাহিদা মেটানোর পর বাংলাদেশের চাহিদার বিষয়টিও মাথায় রাখবে। এতে করে বাংলাদেশের প্রয়োজনের সময় ভারত ওই পণ্যগুলোর জোগান নিশ্চিত করার চেষ্টা করবে। দুই দেশের শীর্ষ নেতার আলোচনায় বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পাবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চার দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে সোমবার ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি এসে পৌঁছান। তার এই সফরের দ্বিতীয় দিন মঙ্গলবার বাণিজ্যসংক্রান্ত চুক্তি ছাড়াও কয়েকটি সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার কথা রয়েছে, তবে চুক্তি ও সমঝোতা সংক্রান্ত নির্ধারিত এজেন্ডা যাই থাক, এর বাইরেও অনেক বিষয় আলোচনা হবে।
২০১৯ সালের অক্টোবরে দিল্লি সফরের পর গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের অধিবেশনে গিয়ে সেখানে একান্ত বৈঠক করেছিলেন শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি।
ওই বৈঠকের পর কেটে গেছে এক বছর। পরে মুজিববর্ষের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে নরেন্দ্র মোদি ঢাকায় এলেও দ্বিপক্ষীয় অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সামনে আসেনি।
এবার জাতিসংঘের অধিবেশনে নরেন্দ্র মোদির যোগ দেয়ার বিষয়টি এখনও নিশ্চিত নয়। তার পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্রে যেতে পারেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তাই এই সফর ছাড়া আগামীতে দুই প্রধানমন্ত্রীর দেখা হওয়ার তেমন সম্ভাবনা নেই বলে মনে করা হচ্ছে।
এ অবস্থায় আজকের বৈঠকেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে জরুরি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা শেষ করতে চান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব মুখোমুখি হয়েছে জ্বালানি সংকটের, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের ওপরও। কিছুদিন আগে বাংলাদেশ সরকার জ্বালানি তেলের দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছে। শতভাগ বিদ্যুতায়নের পরও জ্বালানি সংকটের কারণে লোডশেডিংয়ের মতো সিদ্ধান্তে যেতে হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারকে। তাই এ সংকট মোকাবিলায় ভারতের সহযোগিতা চাইতে পারে বাংলাদেশ।
মিয়ানমার থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের আর কতদিন টানবে বাংলাদেশ, এমন প্রশ্ন এখন সারা দেশের মানুষের। বাস্তুহারা রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নানা সংকটের কারণ হয়েছে।
এদিকে গত এক মাসে অন্তত তিন দফায় মিয়ানমারের মর্টার শেল ও গোলা এসে পড়েছে বাংলাদেশের ভেতর। বিষয়টিতে উদ্বেগ জানিয়ে কড়া প্রতিবাদ করেছে বাংলাদেশ। নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে আজকের বৈঠকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনে ভারতের জোরালো ভূমিকা আশা করবে বাংলাদেশ।
প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের সাম্প্রতিক ভূমিকায় সতর্ক ভারত। গত কয়েক বছরে দেশ দুটি সীমান্তে একাধিকবার মুখোমুখি হয়েছে। তাই ভারত আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক ইস্যুতে বাংলাদেশের সহযোগিতা চাইতে পারে। দেশটি বাংলাদেশে যৌথ সামরিক কারখানা করতে চায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ সফরেই বিষয়টি নিশ্চিত করতে চায় দিল্লি। আজকের দুই নেতার একান্ত বৈঠকে বিষয়টিও আলোচনায় উঠতে পারে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে আলাপ-আলোচনা হলে এতদিনের সম্পর্ক আরেকটু নিবিড় হবে। এতে অমীংমাসিত বিষয়গুলো হয়তো সমাধানের দিকে যাবে।
‘দ্বিতীয়ত, নতুন সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা হবে। বর্তমানে বৈশ্বিক বা আঞ্চলিক পরিবেশ বদলে যাচ্ছে। সেই প্রেক্ষাপটের আলোকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই সফরে নতুন কিছু চিন্তাভাবনা আসবে।’