ময়মনসিংহ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে হয়রানি ও ভোগান্তির দৃশ্য ধারণ করতে গিয়ে সম্প্রতি নিগৃহীত হয়েছেন একজন গণমাধ্যমকর্মী। সেই অফিসের কর্তাব্যক্তি তার অধস্তনদের নির্দেশ দিয়েছেন কোনো গণমাধ্যমকর্মী যেন ভিডিও করতে না পারে। তবে অনিয়ম-দুর্নীতি, ঘুষের যেসব অভিযোগ আছে সেগুলোর প্রতিকারের কোনো ব্যবস্থা তো করা হয়নি, উল্টো সব অস্বীকার করছেন কর্মকর্তারা।
পাসপোর্ট অফিসে গত কয়েক মাস ধরে কর্মকর্তারা বুক ফুলিয়ে বড়াই করছেন যে, সেখানে সব অনিয়ম-দুর্নীতি দূর হয়ে গেছে। দালালদের সঙ্গে কারও যোগসাজশ নেই। কিন্তু ভুক্তভোগীরা বলছেন, বাস্তব পরিস্থিতি পুরো বিপরীত।
সেবাগ্রহীতারা অভিযোগ করছেন, দালাল ছাড়া সেখানে কাজ হয় না। নিজে নিজে করতে গেলে ধরা হয় নানা ভুল। তবে দুর্নীতিমুক্ত অফিস হিসেবে প্রচারের জন্য স্থানীয়দের কাজগুলো আগে করে দেয়া হয়।
গণমাধ্যমকর্মীকে ঢুকতে না দেয়ার ঘোষণা
রোববার বেলা ৩টায় অফিসে তথ্য সংগ্রহ করতে যান দৈনিক শেয়ারবিজ পত্রিকার স্থানীয় প্রতিনিধি রবিউল আওয়াল রবি৷ তিনি বিভিন্ন সেবাগ্রহীতার সঙ্গে কথা বলছিলেন। চলে আসার আগ মুহূর্তে হঠাৎ দেখতে পান কার্যালয়ের ভেতরে লাইনে দাঁড়ানো সেবাগ্রহীতাদের হট্টগোল। তাৎক্ষণিক নিজের মোবাইলে সেই দৃশ্য ধারণ করতেই বাধে বিপত্তি।
তিনি ভিডিও করছেন দেখে প্রথমে বাধা দেন পাশে থাকা আনসার সদস্যরা। এরপর খবর পেয়ে পুলিশ এসে ভিডিও ধারণ বন্ধ করতে বাধ্য করেন। পরে সেই সাংবাদিককে উপপরিচালক হাফিজুর রহমানের নির্দেশে উপরতলায় তার কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে হাফিজুর তাকে অপদস্ত করে কক্ষ থেকে বের করে দেন। রবি যেন কখনও পাসপোর্ট অফিসে ঢুকতে না পারেন, সে জন্য পুলিশকে নির্দেশ দেন উপপরিচালক।
গণমাধ্যমকর্মী রবি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এই পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তারা বলেন, তারা এক টাকাও কারও কাছ থেকে ঘুষ নেন না। দালালদের দৌরাত্ম্য তারা বন্ধ করেছেন। বাস্তবে এর সত্যতা যাচাই করতেই গিয়েছিলাম। এ সময় সেবাগ্রহীতারা জানিয়েছেন, তারা দালালদের মাধ্যমেই সরকার নির্ধারিত টাকার চেয়ে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে আবেদন করতে বাধ্য হয়েছেন। নয়তো পদে পদে ভোগান্তির সৃষ্টি হতো।’
সেবাগ্রহীতাদের বক্তব্য তুলে ধরে এই সাংবাদিক বলেন, ‘দালালদের মাধ্যমে আবেদন করলে যথাসময়ে দ্রুত পাসপোর্ট হাতে পাওয়া যায়। তবে নিজে আবেদন করলে পাসপোর্ট অফিসে নানা ভুল ধরা হয়। স্থানীয়ভাবে পরিচিত লোকজন কিংবা দালালদের ঘুষ ছাড়াই আবেদন করেছে জানিয়ে গুটিকয়েক উপপরিচালকের কক্ষে গেলে তাদের পাসপোর্টও দ্রুত দিয়ে দেয়া হয়। এতে গুটিকয়েক সেবাগ্রহীতা সন্তুষ্ট হলেও বেশির ভাগই দালালদের ঘুষ দিয়ে অসন্তুষ্ট।’
তাকে হেনস্তার বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে রবি বলেন, ‘সেবাপ্রার্থীরা ভোগান্তিতে পড়লে উনাদের (কর্মকর্তাদের) দায়িত্ব কি সাংবাদিককে থামানো নাকি ভোগান্তি দূর করা? পাসপোর্ট অফিস কি কোনো কর্তার পৈতৃক সম্পত্তি যে কোনো সাংবাদিক ছবি কিংবা ভিডিও করতে পারবে না?’
সেবাগ্রহীতারা যা বলছেন
পাসপোর্ট অফিসে সেবার মান সম্পর্কে জানতে কয়েকজন সেবাগ্রহীতার সঙ্গে কথা বলেছে নিউজবাংলা।
ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা থেকে আসা শ্যামল মিয়া নামের একজন বলেন, ‘পাসপোর্টে আমার বাবা-মায়ের নাম ভুল। পাঁচ বছর হয়ে গেল। বিদেশ যাব, এ জন্য গত ১ আগস্ট ভুল সংশোধন ও দশ বছরের জন্য সময় বাড়াতে আবেদন করতে পাসপোর্ট অফিসে গিয়েছিলাম। তখন নিচতলার এক কর্মকর্তা বলেন, যথাযথভাবে আবেদন করে কাগজপত্র নিয়ে আসেন। কিন্তু অফিসের মূল ফটকের দুই পাশের রাস্তায় কম্পিউটারে আবেদন করার দোকান খুলে বসেছেন দালালরা। সেখানে গেলে একজন সর্বোচ্চ ১৩ হাজার টাকা চেয়েছেন। পরে আরেকটি কম্পিউটারের দোকানে গিয়ে দালালকে দর-কষাকষির মাধ্যমে ১২ হাজার টাকা নগদ দিয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘ওই দালাল বলেছেন, পাসপোর্ট অফিসেও সেই টাকার ভাগ দিতে হবে। সর্বোচ্চ এক মাসের মধ্যেই পাসপোর্ট হাতে পাব বলে আমাকে জানানো হয়েছে। এক দালালের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানিয়েছেন, আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই পাসপোর্ট পাওয়া যাবে।’
হাসানুল হক নামের আরেকজন বলেন, ‘যারা স্থানীয় পরিচিত ব্যক্তি অথবা পরিচিত ব্যক্তির মাধ্যমে আসেন তারা উপপরিচালকের হাতে সরাসরি কাগজপত্র জমা দেন। তাদের সরকার নির্ধারিত টাকা খরচেই পাসপোর্ট দেয়া হয়৷ আমাদের মতো সাধারণ সেবাগ্রহীতাদের বাধ্য হয়ে দালালদের খপ্পরে পড়তে হয়।
‘কিন্তু এসব জেনেও না জানার ভান করেন কর্মকর্তারা। কার্যালয়টির সামনে থেকে দালালচক্রের উৎখাত করতে পারলেই সেবাগ্রহীতারা ভোগান্তি ছাড়াই স্বাচ্ছন্দ্যে পাসপোর্ট করতে পারবে।’
অনিয়ম দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে সোচ্চার ময়মনসিংহ ‘জন উদ্যোগ’ এর আহ্বায়ক নজরুল ইসলাম চন্নু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পাসপোর্ট অফিসে সেবাগ্রহীতাদের ভোগান্তি চিরচেনা চিত্র। তারা যেন দালালমুক্ত সেবা নিতে পারে, সে জন্য কর্মকর্তাদের ভূমিকা পালন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমকর্মীদের ভূমিকা সহায়ক। কিন্তু কর্মকর্তারা সেটি না করে গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর চড়াও হচ্ছেন। এটা কোনোভাবে মানা যায় না।’
রবির অভিযোগ ও সেবাগ্রহীতার ভোগান্তির বিষয়ে বক্তব্য জানতে ময়মনসিংহ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের উপপরিচালক হাফিজুর রহমানের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ওই দিন সাংবাদিক এসে ভিডিও ধারণ করছিলেন। তখন আনসার ও পুলিশ তাকে বলেছেন উপপরিচালকের অনুমতি নিয়ে ভিডিও করতে। উপপরিচালক সিসি ক্যামেরা দিয়ে দেখতে পেয়ে তার নির্দেশে সাংবাদিককে কক্ষে আনা হয়। কী সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশ করবে জিজ্ঞেস করা হয়। কিন্তু অপমান-অপদস্থ করা হয়নি। আর কখনও অফিসে আসতে না দেওয়ার কথাও বলা হয়নি।’