দেশের প্রধানমন্ত্রী চা শ্রমিকদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলবেন, আমাদের জন্য সময় ব্যয় করবেন- এইটা তো আমাদের বাবা-দাদাও কোনোদিন কল্পনা করেনি। কিন্তু এই যুগে এসে প্রধানমন্ত্রী সত্যি সত্যিই আমাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। একদিন নিশ্চয়ই তিনি আমাদের সঙ্গে চা খেতেও আসবেন।
দৃঢ়তার সঙ্গেই কথাগুলো বললেন শ্যামলী গোয়ালা। সিলেটের লাক্কাতুরা চা বাগানের শ্রমিক তিনি। রোববার সন্ধ্যায় বাগানের শ্রমিক বস্তিতে গিয়ে তার সঙ্গে আলাপ হয় নিউজবাংলার।
এর আগে শনিবার চা শ্রমিকদের সঙ্গে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে মতবিনিময় করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এতে সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও চট্টগ্রাম থেকে যুক্ত হন চা শ্রমিকরা।
মতবিনিময় সভায় বক্তব্য রাখার সুযোগ হয়েছিল লাক্কাতুরা বাগানের শ্রমিক শ্যামলী গোয়ালার। বক্তব্যে নিজেদের দাবি-দাওয়া জানানোর পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীকে নিজের বাসায় চা পানেরও আমন্ত্রণ জানান তিনি।
রোববার বিকেলে লাক্কাতুরা বাগানের শ্রমিক বস্তিতে গিয়ে শ্যামলীর খোঁজ করতেই দুই শিশু এগিয়ে এসে বলে- ‘কোন শ্যামলী? কাল যে প্রধানমন্ত্রীর সাথে বক্তৃতা করছিল, তিনি নাকি?’
এই শিশুরা শ্যামলীর বাসা চেনে না। তারা টিলার ওপর একটি দোকানের ঠিকানা দিয়ে বলে- ‘এই দোকানে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেই বাসা চিনিয়ে দেবে।’
শিশুদের নির্দেশমতো দোকানে গিয়ে শ্যামলীর ঠিকানা মিলল। দোকানদার রনি তার ঘর দেখিয়ে দিলেন।
কিন্তু ঘরে গিয়ে শ্যামলীকে পাওয়া যায়নি। তিনি সকালেই বাগানে পাতা তোলার কাজে গেছেন। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর সন্ধ্যার দিকে ফিরলেন। এ সময় আলাপ হয় আগের দিন তার বক্তব্য আর প্রধানমন্ত্রীকে চায়ের আমন্ত্রণ জানানোর বিষয়ে।
শ্যামলী বলেন, ‘তিনি আমাদের সাথে চা খেতে আসলে তো ভালো হবে। আমরা খুশি হব।’
মতবিনিময় সভায় চা খাওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে নিজের ঘরে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন শ্যামলী। কিন্তু রোববার তার উপলব্ধি হয়- তার ঘরটি ভাঙাচোরা! প্রধানমন্ত্রীকে আপ্যায়ন করার মতো উপযুক্ত নয়।
শ্যামলী বলেন, ‘আমার ঘর তো ভাঙা! বসার জায়গাও নেই। তবে আমাদের বাগানের ক্লাবঘর আছে। তিনি এলে তাকে সেখানে নিয়ে গিয়ে চা খাওয়াব।’
বক্তব্য দেয়ার সুযোগটি কীভাবে এলো- এ বিষয়ে শ্যামলী বলেন, ‘এক দিন আগে ভ্যালির নেতারা আমারে বলছে- প্রধামন্ত্রীর সাথে মাতা (কথা বলা) লাগব। মজুরিতে খুশি হয়েছি, এইটা কইতে অইব। তারা জিগাইছে- পারবায়নি মাততায়?’
শ্যামলী বলেন, ‘আমরা মূর্খ মানুষ। কথা কলতে পারি না। তবে আমার ছেলেমেয়েরা পড়ালেখা করছে। বাচ্চাকাচ্চারা সাহস দিছে। বলছে, এই রকম মাতবে। তাদের সাহসে রাজি হইছি। এরপর মন থেকে যা আইছে তাই বলেছি। কোনো ট্রেনিং নিই নাই। নিজেদের দুঃখের কথা বলছি। আমরা প্রত্যেক দিন যেই সমস্যায় থাকি সেগুলার কথা বলছি।’
৫০ টাকা মজুরি বাড়ায় খুশি হয়েছেন জানিয়ে শ্যামলী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীরে সেইটা কইছিও। কইছি, আপনে যেটা দিয়েছেন খুব খুশি হয়েছি।
‘আরও কইছি- বিরশইতবারে (বৃহস্পতিবার) বেতন পাইলে শুক্রবার শেষ অই যায়। বড় অসুখ হইলে কী করব? আমাদের তো হাসপাতালে যাওয়ার মতো টাকা নাই! তাই বাগানে একজন এমবিবিএস ডাক্তার চাইছি। একটা অ্যাম্বুলেন্সও চাইছি। আমাদের বাচ্চাকাচ্চাদের যাতে ঘর থেকে উচ্ছেদ হইতে না হয় তাই ভূমির অধিকার চাইছি।’
দাবিগুলো একদিন পূরণ হবে বলেও আশা করেন শ্যামলী। তিনি বলেন, ‘প্রধামন্ত্রী যদি বিবেচনা করেন, আজ না হোক ২৫ বছর পরে হলেও নিশ্চয়ই আমাদের দাবি পূরণ হবে।’
শ্যামলীর দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। মতবিনিময় সভায় শিশুদের পুষ্টির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া আশ্বাস নিয়ে শ্যামলী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বলছেন পুষ্টি খাবার দেবে। আমার ছেলেমেয়েও নিশ্চয়ই পাবে।’
শনিবার মতবিনিময় সভায় সিলেটের লাক্কাতুরা গলফ ক্লাব মাঠ থেকে অংশ নেন সিলেটের চা শ্রমিকরা। এতে নেতা, মন্ত্রী ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রথম সারিতে বসা ছিলেন দুই চা শ্রমিক। এদের একজন শ্যামলী গোয়ালা ও অন্যজন মুক্তি লোহার।
মুক্তিরও বক্তব্য দেয়ার কথা ছিল প্রধানমন্ত্রীর সামনে। কিন্তু গলায় সমস্যার কারণে তিনি কথা বলতে পারেননি। তবে প্রধানমন্ত্রীর দেখা পেয়েই উচ্ছ্বসিত মুক্তি। জানালেন আনন্দের অতিশয্যে শনিবার রাতে তার ঘুমই হয়নি।
মুক্তি বলেন, ‘আমার তো মনে হইছে ভগবান নামিয়া আইছে। সারা রাত প্রধানমন্ত্রীরে স্বপ্ন দেখছি। রাতে জ্বর চলে আসছিল। মনে হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী পর্দা সরাইয়া আমাদের কাছে চলে আসছেন!’
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মতবিনিময় সভায় সিলেট থেকে বক্তব্য রাখেন চা শ্রমিক ইউনিয়নের সিলেট ভ্যালির সভাপতি রাজু গোয়ালাও।
রোববার তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আজ জেলা প্রশাসক আমারে ডেকে নিয়েছিলেন। আমার সামনেই তিনি সিভিল সার্জনের সাথে কথা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশমতো বাগানের পাশে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের ব্যবস্থা করতে সিভিল সার্জনকে বলেছেন তিনি।’
এ বিষয়ে সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী চা শ্রমিকদের ব্যাপারে খুবই আন্তরিক। শনিবারের মতবিনিময় সভা তারই প্রমাণ। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশমতো চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে আমরা পদক্ষেপ নিচ্ছি।’
দৈনিক মজুরি ৩০০ টাকার দাবিতে গত ৯ আগস্ট থেকে আন্দোলন করছিলেন চা শ্রমিকরা। টানা ১৮ দিন কর্মবিরতির পর প্রধানমন্ত্রী মজুরি ৫০ টাকা বাড়িয়ে ১৭০ টাকা করলে কাজে ফেরেন শ্রমিকরা।
তবে আন্দোলনের শুরু থেকেই চা শ্রমিকরা দাবি জানিয়ে আসছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সরাসরি কথা বলার জন্য। সে সুযোগ হয়েছে শনিবার বিকেলে। গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে চা শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এ সময় চা শ্রমিকদের বক্তব্য শুনে তাদের দাবি পূরণের আশ্বাস দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের চা শ্রমিকরা, যাদের ব্রিটিশরা একসময় নিয়ে এসেছিল, তাদের অমানবিক অত্যাচার করত, খাটাত। জাতির পিতা শেখ মুজিব টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হওয়ার পর বিভিন্ন ব্যবস্থা নেন এবং পরবর্তীতে তাদের নাগরিকত্ব দেন, ভোটের অধিকার দেন।
‘ভোটের অধিকার পেয়েছে, নাগরিকত্ব পেয়েছে, কিন্তু তারা ভূমিহীন থাকবে, এটা তো হতে পারে না।’