প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর সামনে রেখে আলোচিত ‘সমন্বিত অর্থনৈতিক পরিকল্পনা- সিইপিএ’ চুক্তির পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এর মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে বছরে ৪০ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর এ সফরেই চুক্তিটি স্বাক্ষরের আশা করছে ভারত। ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রস্তাবিত বাংলাদেশ-ভারত সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি (সিইপিএ) নামের এই পরিকল্পনায় দুই দেশের বাণিজ্যের পরিমাণ বাড়ানোর উপায় এবং ধাপে ধাপে বাণিজ্য ব্যবধান কমানোর কথা বলা হয়েছে।
গত মার্চে এ চুক্তির খসড়া ঢাকায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠায় নয়দিল্লির বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। মে মাসের শেষে গোহাটিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এ চুক্তির খসড়া নিয়ে আলোচনা করেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্কর।
নয়াদিল্লির কূটনীতিক সূত্র জানায়, প্রস্তাবিত চুক্তিতে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর উপায় খুঁজেছে ভারত। এ জন্য প্রয়োজনে বাংলাদেশের মাটিতে সামরিক-বেসামরিক শিল্পে বিনিয়োগ করে উৎপাদিত পণ্য ও সরঞ্জাম ভারতে আমদানির কথা বলা হয়েছে।
বাংলাদেশের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি ১ মার্চ থেকে ৪ মার্চ ভারত সফর করে এবং সিইপিএ এর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য জয়েন্ট স্টাডি গ্রুপ (জেএসজি) দুই দেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে সুপারিশ উপস্থাপন করে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রস্তাবিত সিইপিএর তিনটি মাত্রা রয়েছে- পণ্য, পরিষেবা ও বিনিয়োগে বাণিজ্য।
ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বরাতে দিল্লির কূটনৈতিক সূত্র জানায়, প্রস্তাবিত সিইপিএর মূল লক্ষ্য বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিশাল বাণিজ্য ব্যবধান কমানো এবং সংযোগ, নতুন বাজার, সহযোগিতা ও অংশীদারিসহ নতুন অর্থনৈতিক সুযোগ উন্মুক্ত করা।
এ ছাড়া সিইপিএতে বহুমাত্রিক সংযোগের দৃষ্টিকোণ এবং উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতাকে গভীর করার দৃষ্টিকোণের মাধ্যমে অ্যান্টিডাম্পিং শুল্ক এবং উৎস করসহ অন্য চ্যালেঞ্জ সমাধান করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এটি দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ককে উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে নিয়ে যাবে বলে মনে করে ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
সম্প্রতি ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের দাপ্তরিক বিবৃতিতে বলা হয়, সিইপিএ পারস্পরিক স্বার্থের বিভিন্ন বিষয় অন্তর্ভুক্ত করবে। যার মধ্যে রয়েছে রেল ও বন্দর অবকাঠামো, সীমান্ত হাট, এবং মাল্টি-মোডাল পরিবহনের মাধ্যমে আঞ্চলিক সংযোগ, হারমোনাইজেশনের উন্নয়ন ও যৌথ মান নিয়ন্ত্রণ।
এ ছাড়া সিইপিএর অধীনে সবুজ প্রযুক্তি, পুনর্ব্যবহারযোগ্য জ্বালানি, আইটি এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মতো নতুন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়ানোর জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে, যা বিনিয়োগের সুযোগকে শক্তিশালী করবে। চুক্তিটিতে ভারত-বাংলাদেশ অংশীদারত্বকে শক্তিশালী করার জন্য চারটি ক্ষেত্রের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে কানেক্টিভিটি এবং ভারত থেকে পেঁয়াজ ও তুলার অনিশ্চিত সরবরাহের পরিপ্রেক্ষিতে একটি নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের চেইন বজায় রাখা। প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের যৌথ উৎপাদন, বিনিয়োগের সম্ভাব্য ক্ষেত্র, ভ্যাকসিন এবং অন্য ওষুধের যৌথ উৎপাদন।
চুক্তির সুবিধা ব্যাখ্যা করে একজন কূটনীতিক নিউজবাংলাকে বলেন, ক্রমবর্ধমান দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পটভূমিতে, আমদানি, রপ্তানি এবং সংশ্লিষ্ট বিধিবিধানসহ দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ব্যবস্থা নতুন গতি পাবে। কারণ চুক্তিতে যৌথভাবে কাজ করার উপকরণ রয়েছে। এটি বাণিজ্য, সরবরাহ লাইন এবং উৎপাদন নিশ্চিত করবে।
তিনি বলেন, সিইপিএ চালু হলে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের সম্ভাবনা হবে ৪০ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ভারতে তার শেষ সফরের সময় দৃঢ়ভাবে বলেছিলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে সিইপিএ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সিইপিএ সংযোগের একটি ক্লাস্টার তৈরি করবে যা এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্ক রুট (এএইচ১ ও ২), বিবিআইএন, বিসিআইএম এবং বিমসটেক, পেট্রাপোল-বেনাপোল, ফুলবাড়ী-বাংলাবান্ধা এবং ডাউকিতে ভারত ও বাংলাদেশকে সংযুক্ত করে ভবিষ্যৎ বাণিজ্যকে রূপ দেবে। তামাবিল পয়েন্ট এবং আখাউড়া (বাংলাদেশ) এবং আগরতলা (ভারত) এর মধ্যে একটি নতুন রেল সংযোগ তৈরি করবে।
ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দাবি, সিইপিএ একবার সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হলে, চুক্তিটি সীমান্তের ওপারে ব্যক্তিগত, যাত্রী এবং পণ্যবাহী যানবাহন যাতায়াত সহজ করবে। এটি বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান হবে, যেখানে পণ্যের দাম চার থেকে ৫ শতাংশের বেশি কমতে পারে। এ ছাড়া স্থানীয়ভাবে নতুন নতুন ব্যবসার খাত উন্মুক্ত করবে, ট্রানজিট ব্যবসা নতুন রূপ পাবে এবং ভোক্তাদের খরচ কমাবে ও আয় বাড়াবে। কারণ প্রচুর অর্থনৈতিক কার্যক্রম শুরু হবে।
ভারতীয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিইপিএ চুক্তি অনুযায়ী যখন প্রোডাকশন হাব এবং সাপ্লাই চেইন বাস্তবায়িত হবে, তখন এটি উভয় দেশের জন্যই একটি নতুন বাজার তৈরি করবে এবং আগামী দিনে বিনিয়োগ একটি নতুন পথ দেখাবে। বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের জন্য তিনটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন করেছে এবং ভারতীয় কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে টেলিকমিউনিকেশন, ফার্মাসিউটিক্যালস, এফএমসিজি এবং অটোমোবাইলসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করছে।
ভারত ও বাংলাদেশ এক্ষেত্রে সিইপিএ-এর মাধ্যমে বাণিজ্য ও বিনিয়োগে যে আরও জোরালো দ্বিপাক্ষিক সম্পৃক্ততা তৈরি করবে। এছাড়াও সিপিইএ ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলিতে বাংলাদেশের রাসায়নিক সার, কাঁচা পাট এবং পাটজাত পণ্য হিমায়িত মাছ এবং তৈরি পোশাকের (আরএমজি) জন্য বাজার তৈরি করবে।
বাংলাদেশের বাণিজ মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, সিইপিএর লক্ষ্য হচ্ছে বাণিজ্য সংক্রান্ত জটিলতা, ট্যারিফ, সরকারি ক্রয়, বিনিয়োগ, সংযুক্তি ও বিনিয়োগের সুরক্ষাসহ আরও বেশ কিছু বিষয় নিয়ে কাজ করা। বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার বিভিন্ন জটিলতাকে দূর করার জন্যেও এটি একটি বড় আকারের উদ্যোগ।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, সিইপিএ ঠিকমতো প্রতিষ্ঠিত হলে দুই দেশের আমদানিকারক ও রপ্তানিকারকরা ব্যাবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য তাদের সুবিধামতো চুক্তি বেছে নিতে পারবেন। ইতোমধ্যে সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক মুক্তবাণিজ্য চুক্তি (সাফটা) চালু আছে। ভারত তার স্ট্র্যাটেজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার কারণে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদারে পরিণত হয়েছে।