১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার রাতে যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মনিকে হত্যার নিন্দা জানিয়েছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
অবশ্য সেই হত্যাযজ্ঞের খুনিদের আইনি সুরক্ষা দিতে জারি করা ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের আমলে সংবিধানের অংশ করার বিষয়ে কিছু বলেননি বিএনপি নেতা।
তবে সম্প্রতি শেখ মনির দুই ছেলে শেখ ফজলে নূর তাপস ও শেখ ফজলে শামস পরশকে সমাবেশের মঞ্চে ডেকে নিয়ে শেখ হাসিনার স্নেহ করা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন বিএনপি নেতা। বলেছেন, পরশ-তাপসের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কান্না এলেও গুম হয়ে যাওয়া পরিবারের জন্য কেন আসে না।
শনিবার নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপির উদ্যোগে এক সমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন। নারায়ণগঞ্জে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে যুবদল কর্মী নিহত হওয়ার প্রতিবাদে এই সমাবেশের আয়োজন করা হয়।
এ সময় রিজভী সম্প্রতি জাতীয় শোক দিবস স্মরণে আওয়ামী লীগের আলোচনায় শেখ তাপস ও পরশকে মঞ্চে ডেকে নিয়ে তাদের ধরে প্রধানমন্ত্রীর কান্না নিয়ে কথা বলেন।
গত ৩০ আগস্ট এই আলোচনায় শেখ হাসিনা যখন মঞ্চে ছিলেন, তখন পরশ ও তাপসকে ডেকে নেন তিনি। ১৫ আগস্টের হত্যাযজ্ঞের কথা স্মরণ করে আওয়ামী লীগ প্রধান বলেন, ‘আজকে ওরা বড় হয়ে গেছে। পাঁচ বছরের পরশ, তিন বছরের তাপস। বাবা-মায়ের লাশ পড়ে আছে। দুটি বাচ্চা বাবা-মায়ের লাশের কাছে গিয়ে চিৎকার করছে। বাবা ওঠো, বাবা ওঠো। মা ওঠো, মা ওঠো। সেদিন কেউ সাড়া দেয়নি।’
রিজভী বলেন, ‘দুই-তিন দিন আগে অবৈধ প্রধানমন্ত্রী পরশ এবং তাপসকে ধরে কান্না করেছেন তাদের বাবাকে হত্যা করা হয়েছে তার জন্য। আমরাও এটার নিন্দা করি যারা তাদের বাবাকে হত্যা করেছে তার জন্য।
‘কিন্তু ইলিয়াস আলী গুম, তার ছেলে যে কান্না করছে, চৌধুরী আলমের স্ত্রী কান্না করছে, সুমনের মা কান্না করছে। এইটা আপনি প্রধানমন্ত্রীর অনুধাবন হয় না? পরশ আর তাপসের জন্য কান্না আসে। ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলম- এদের জন্য কান্না আসে না? নুর আলম, রহিম, শাওনের জীবন চলে গেছে। আর আপনি প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কথা বলা যাবে না।’
’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার রাতে হামলা হয় শেখ মনি এবং বঙ্গবন্ধুর ভাই আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়িতেও। সেখানেও চলে হত্যাযজ্ঞ।
এই হত্যার পরই নানা ঘটনাপ্রবাহে ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও সে সময়ের সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান। এই হত্যাযজ্ঞের পর খুনিদের আইনি সুরক্ষা দিয়ে রাষ্ট্রপতি খোন্দকার মোশতাক আহমেদ যে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেছিলেন, জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর সেটিকে করা হয় সংবিধানের অংশ।
এ কারণে বঙ্গবন্ধু, শেখ মনি বা সেরনিয়াবাত হত্যার বিচারের দাবিতে মামলাও করা যায়নি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল বিল উত্থাপনের দিন বিএনপি সংসদ থেকে ওয়াকআউট করে। আর ওই বছর সেই নির্বাচনের আগে ১৫ আগস্ট যে একতরফা ভোট হয়েছিল, সেই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর দুই খুনিকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত করে আনে বিএনপি।
আবার ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর ১৫ আগস্টের খুনিদের আপিল শুনানি আটকে থাকে পাঁচ বছর। আওয়ামী লীগের অভিযোগ, এই শুনানি যেন না হতে পারে, সে জন্য বিএনপি সরকার আপিল বিভাগে বিচারক নিয়োগ আটকে রাখে। এ কারণে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সব সময় অভিযোগ করা হয়, ১৫ আগস্টের খুনিদের সব সময় বিএনপি রক্ষার চেষ্টা করেছে।
রিজভী অবশ্য শেখ মনি হত্যার নিন্দা করার কথা বললেও ইতিহাসের এই বিষয়গুলো নিয়ে আর কিছুই বলেননি।
‘হামলা, গুম, খুনের নির্দেশদাতা প্রধানমন্ত্রী’
বিএনপি নেতার অভিযোগ, বিরোধী দলের ওপর যত আঘাত, নেতাকর্মীদের যত গুম, যত বিচারবহির্ভূত হত্যা সবকিছুর নির্দেশদাতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
রিজভী বলেন, ‘কয়েক দিন আগে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বলেছে, তাদের নেতাকর্মীরা রাজপথে থাকবে। সে রাজপথে থাকার পরিণতি আমরা দেখছি শাওনের লাশ। তারা মাঠ দখলে রাখবে। সেই দখলে রাখার নমুনা হচ্ছে শাওনের রক্তাক্ত, রক্ত ভেজা শার্ট।
‘এই নমুনা তারা যে আরও কত দেখাবে! এই নমুনা তারা যে কোন পর্যায়ে নিয়ে যাবে তা বলা মুশকিল। কারণ যে দেশের প্রধানমন্ত্রী সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে বলে পদ্মা সেতু থেকে টুস করে ফেলে দেবে, আন্তর্জাতিক সম্মান নিয়ে আসা ব্যক্তি ড. ইউনূসকে বলে দুইবার চুবানি দেয়া দরকার, দেশের অর্থনীতিবিদদের বলেন, তারা কিছুই জানে না, সেই প্রধানমন্ত্রী যদি মহিলা না হয়ে পুরুষ হতেন, তাহলে শামীম ওসমানের চেয়ে বড় গুন্ডা হতেন, এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।’
রিজভী বলেন, ‘এইটা প্রধানমন্ত্রীর কোনো ভাষা হতে পারে? এই ভাষাতেই তারা চলছে।’
বিএনপিকে নির্বিঘ্নে আন্দোলন করে দেয়ার কথা বলে প্রধানমন্ত্রীর কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিষয়টি প্রমাণ হয়েছে বলেও মনে করেন রিজভী।
তিনি বলেন, ‘১৪ আগস্ট আপনি বলেছেন, বিএনপি গণভবন ঘেরাও করবে, তাদের করতে দিন। তাদের মিটিং-মিছিল করতে বাধা দেবেন না। আপনি নির্দেশ দেয়ার কে? বিএনপি মিটিং-মিছিল করবে, কথা বলবে এটা তো স্বাধীনতা। আপনি আলাদাভাবে নির্দেশ দিচ্ছেন কেন? আপনি গণতন্ত্র হরণকারী, ১৪ আগস্টের বক্তব্যে আপনি তা প্রমাণ করেছেন।
‘আর আপনি বলেছেন, আপনি করুণা করে খালেদা জিয়াকে বাসায় থাকতে দিয়েছেন। তাহলে আপনি করুণা করে তাকে জেলে ভরেছিলেন? আমরা বলেছি, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মামলা আপনার নির্দেশে হয়েছে। আপনার কথার মাধ্যমে তা প্রমাণ হয়েছে।’
নেতাকর্মীদের আন্দোলনের আহ্বান জানিয়ে রিজভী বলেন, ‘আর কোনো সময় নেই। মিটিংয়ে মিছিলে কণ্ঠের উচ্চারণে এ সরকারকে পদত্যাগ করাতে হবে। আর এই পদত্যাগের মাধ্যমেই দেশে শান্তি আসবে, গণতন্ত্র আসবে, দেশমাতা বেগম খালেদা জিয়া মুক্তি হবে, গণতন্ত্রের নেতা তারেক রহমান দেশে ফিরে আসবেন।
‘রাজপথের প্রত্যেকটা জায়গায় আন্দোলনের ঝড়ো হাওয়া বয়ে দিতে হবে। এ ছাড়া কোনো উপায় নেই।’
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আব্দুস সালামের সভাপতিত্বে সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদীন ফারুক, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান।