ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নয়াদিল্লি সফরে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা আরও জোরদার হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছে দুই দেশ।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বদলে যাওয়া বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট এবং দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ৫ থেকে ৮ সেপ্টেম্বর ভারত সফর করবেন বাংলাদেশের সরকারপ্রধান।
প্রতিবেশী দেশটিতে প্রধানমন্ত্রীর সফর শুরুর আগে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এর মধ্য দিয়ে বন্ধুপ্রতিম দুই রাষ্ট্রের সহযোগিতার নতুন দুয়ার খুলবে।
এতে আরও বলা হয়, এ সফর উভয় দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
অন্যদিকে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফর শক্তিশালী ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধন এবং পারস্পরিক আস্থা ও বোঝাপড়ার ভিত্তিতে তৈরি দুই দেশের বহুমুখী সম্পর্ককে আরও জোরদার করবে।
২০১৯ সালের অক্টোবরে সর্বশেষ ভারত সফরে যান শেখ হাসিনা, যার তিন বছর পর আবার দেশটিতে যাচ্ছেন তিনি। যদিও মুজিব শতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে বাংলাদেশ সফর করে গেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও সাবেক রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে অথবা ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশে নির্বাচন হওয়ার কথা। সে হিসাবে ভোটের আগে এটাই হতে পারে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ ভারত সফর।
কী ভাবছেন কূটনীতিকরা
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির মনে করেন, সফরটি নির্বাচনের আগে হওয়ায় স্বাভাবিক কারণেই দুই দেশের নেতাদের মধ্যে রাজনৈতিক বিষয়ে কথাবার্তা হবে৷
তিনি বলেন, ‘দুই দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক আছে, কিন্তু সেই সম্পর্ক সমতার কি না, এটা প্রশ্ন। দেনা-পাওনার হিসাবে ধরলে আমরা কম পাচ্ছি। ভারতকে আমরা যে রকম সুযোগ-সুবিধা দিই, আমরাও সে রকম সুযোগ-সুবিধা চাই। আর এটা সুষম হতে হবে।
‘তিস্তার পানি দিচ্ছে না, কিন্তু আরও ছয়-সাতটি নদীর পানি নিয়েও তো কোনো আগ্রহ দেখি না৷ আসলে আমাদের আগ্রহ থাকলেও তাদের আগ্রহ খুবই কম৷’
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ভারতের বিরুদ্ধে যে বাংলাদেশের মানুষের ক্ষোভ এবং বাংলাদেশের চীনের দিকে ঝুঁকে পড়া, এর তো বাস্তব ভিত্তি আছে৷ দুই-একটি সফর দিয়ে তার অবসান হবে না।’
তিনি বলেন, ‘ভারত নানা অজুহাতে তিস্তার পানি দিচ্ছে না। এবারও দেবে না। আবার সামনে নির্বাচন আসবে। সেটাকে কারণ দেখিয়ে দেবে না। সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার কথা বলা হলেও তা বন্ধ হচ্ছে না।
‘তারা বলছে সীমান্তে অপরাধ হচ্ছে। পৃথিবীর সব দেশের সীমান্তেই অপরাধ হয়। ভারত যা চায়, তা পায়। আমরা যা চাই, তা পাই না।’
তিনি আরও বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে আমাদের সবসময়ই কথা হয়; আলাপ-আলোচনা হয়। এটা তো রুটিন কাজ, কিন্তু অর্জন কী হয় সেটাই প্রশ্ন। গত ১০-১২ বছরে বাংলাদেশের কোনো সমস্যার সমাধান হয়নি৷’
আলোচনা, সিদ্ধান্ত কোন কোন বিষয়ে
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, সফরে ভারত থেকে সামরিক সরঞ্জাম কেনার বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসতে পারে। ২০১৯ সালে এ সংক্রান্ত চুক্তি করে বাংলাদেশ। সে অনুযায়ী সরঞ্জাম কিনতে ভারত ৫০ কোটি ডলার ঋণ দেবে৷
গত জুলাইয়ে ঢাকা সফরের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন ভারতের সেনাপ্রধান। সাক্ষাতে সরঞ্জাম কেনার বিষয়টি উঠে আসে। সম্প্রতি বাংলাদেশের কর্মকর্তারাও ভারত গিয়ে সরঞ্জাম পরিদর্শন করে এসেছেন বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা আরও জানান, সমুদ্র নিরাপত্তায় ভারত থেকে রাডার ক্রয় নিয়েও কথা হবে আসন্ন সফরে। এর বাইরে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটানকে নিয়ে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে আলোচনা হবে, যার নেতৃত্বে আছে ভারত৷
নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আনতে চায় বাংলাদেশ। একই সঙ্গে এই অঞ্চলে জ্বালানি নিরাপত্তা ও সংযোগের বিষয়টি নিয়ে যৌথভাবে কাজ করতে চায় বাংলাদেশ। ভারতে উদ্বৃত্ত জ্বালানি পেতে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির প্রস্তাবও দেয়া হবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে।
প্রধানমন্ত্রীর সফরে অর্থনেতিক বিষয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সমন্বিত বাণিজ্য চুক্তি সেপা। এ চুক্তি হলে ভারত ও বাংলাদেশের পণ্য দুই দেশে শুল্কমুক্ত প্রবেশের সুবিধা পাবে৷
বাংলাদেশ এরই মধ্যে এ চুক্তি অনুমোদন করেছে। এর সঙ্গে বাংলাদেশ অ্যান্টি ডাম্পিং নীতি নিয়েও কথা বলবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের ভাষ্য, এবারের সফরে বাংলাদেশ সেপা চুক্তিকে গুরুত্ব দিচ্ছে৷ এ ছাড়া পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের বিষয়টি সামনে আনা হবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ যে চীন ও ভারতের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ কূটনীতি চায়, সেটিও তুলে ধরা হবে।
প্রধানমন্ত্রীর সফরসূচি
৫ সেপ্টেম্বর ভারত গিয়ে সেখানকার কূটনীতিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দিল্লিতে বাংলাদেশ দূতাবাস এ আয়োজন করেছে।
মোদির সঙ্গে বৈঠক হওয়ার কথা ৬ সেপ্টেম্বর। দুই নেতার যৌথ ঘোষণায় সুসম্পর্কের বিষয়টিতে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হবে।
সফরে প্রধানমন্ত্রী উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন, যেখানে বেশ কয়েকজন মন্ত্রী, উপদেষ্টা, সচিব ও জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা রয়েছেন।
এ সফরে বাংলাদেশের ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রতিনিধিরাও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে থাকবেন।
সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আনুষ্ঠানিক অভ্যর্থনা জানাবেন ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু। সে সময় তাকে গার্ড অফ অনার দেয়া হবে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন বলে জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
৭ সেপ্টেম্বর ইন্ডিয়ান চেম্বার অফ কমার্স আয়োজিত অনুষ্ঠানে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে বক্তব্য দেবেন প্রধানমন্ত্রী। একই দিন বিকেলে আজমির শরিফে খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (রহ.)-এর মাজার জিয়ারত করবেন তিনি।
৮ সেপ্টেম্বর জয়পুর শহর থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেয়ার কথা রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর।