সড়ক পারাপারের ঝুঁকি অগ্রাহ্য করে চলাচলের যে প্রবণতা আছে, তার একটি রূপ দেখা গেল ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের সাভারে। সেখানে মানুষের দৌড়াদৌড়ি করে রাস্তা পারাপারে উঁচু করে বিভাজক নির্মাণের পরও পথচারীদের থামানো যাচ্ছে না। উঁচু সেই বিভাজককে অতিক্রম করতে রীতিমতো ব্যবহার হচ্ছে মই।
সম্প্রতি এভাবে মই ব্যবহারের একটি ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। অভিযোগ উঠেছে, মাথাপিছু ২ টাকার বিনিময়ে মই বসিয়ে লোকজন পারাপার করানো হচ্ছে।
সেই মইটি বসানো হয়েছিল সাভার নিউ মার্কেট এলাকায়। যদিও ফেসবুকে ভাইরাল হওয়ার পর সেই কান্ড আর ঘটেনি। তবে ঘটনাস্থলে গিয়ে ঝুঁকি নিয়ে শত শত মানুষের পারাপারের দৃশ্য দেখা গেছে।
ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের শিমুলতলা থেকে সাভার বাসস্ট্যান্ডের রানা প্লাজা পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকায় প্রবীণ, তরুন, নারী ও শিশুরাও ঝুঁকি নিয়ে পারাপার হচ্ছে নিত্যদিন।
দেখা গেছে, প্রতি ৫ মিনিটের মধ্যে কেউ না কেউ টপকে ডিভাইডার পার হচ্ছেন। কখনও একই সময়ে আবার দল বেঁধেও পারাপার হতে দেখা যাচ্ছে। পারাপারের সময় সবচেয়ে বিপাকে পড়ছেন প্রবীণ, নারী ও শিশুরা।
শিমুলতলা এলাকায় ঢাকামুখী বাম লেনে ডিভাইডার ঘেঁষে বালুর দুটি বস্তা ফেলা হয়েছে পারাপারের জন্য। এই স্থানেই লোকজনের পারাপার অনেক বেশি।
সাভার বাসস্ট্যান্ডের রানা প্লাজা এলাকা থেকে শিমুলতলা পর্যন্ত এমন ৮-৯ স্থানে এই ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এভাবে রাস্তা পার হওয়া মানুষ ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্টপেজগুলোতে লোকাল বাসগুলো সঠিক লেন দিয়ে প্রবেশ না করায় তাদের এভাবে সড়ক পার হতে হচ্ছে।
অনেকে আবার ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে পারাপার হওয়াকে কষ্টকর মনে করছেন। তাই জোর করেই বাস সড়কের মাঝে থামিয়ে নেমে পড়ছেন।পথচারীদের এভাবে সড়ক পারাপার ঠেকাতে হাইওয়ে ও ট্রাফিক পুলিশের কোনো চেষ্টাই চোখে পড়ে না।
নিউ মার্কেটের সামনের সড়ক দিয়ে গৃহিণী রেহেনা বেগমকে দেখা গেল বোন ও ছোট শিশুসন্তানকে ডিভাইডার টপকে পার হতে দেখা গেল।এভাবে কেন পার হচ্ছেন- জানতে চাইলে রেহেনা বলেন, ‘গতকাল ঢাকা থেকে আসার সময় গাড়িওয়ালা ভুল করে বাম লেন দিয়ে ঢুকে নাই। কারণ সাভার বাসস্ট্যান্ডে সব তো আটকানো। তাই ঝুঁকি নিয়ে অনেকদূর হাঁইটা তারপর বাসায় গেছি।
‘আজ আমরা জাহাঙ্গীরনগর থেকে সাভার আসছি। বাস থেকে ইচ্ছে করে আমরা রাস্তার ভেতরে নামছি। কাটা নাইতো তাই। না হলে ফুটপাতের ওখানে নামলে বাচ্চা নিয়া অনেকদূর হাঁইটা আসতে হয়। আমরা তো কাছেই যাব। ভাইয়া ঝুঁকি ছিল, কিন্তু কী করব? বাচ্চা নিয়া অনেক হয়রানি হইছি।’
নিউ মার্কেটের পাশেই কাঠের শো-পিসের দোকানি জলিল মুনশি বলেন, ‘ডিভাইডার দিছে দুই মাস। ডিভাইডারের দুই দিক দিয়েই গাড়ি চলাচল করে। পার হওয়ার সময় কোনো রকম পইরা গেলেই শ্যাষ। দুই দিক দিয়াই অনেক জোরে গাড়ি চলাচল করে। আর রাত-দিন মানুষ এমনই ঝুঁকি নিয়া পার হয়।
‘আসলে অনেকে বাধ্য হইয়া পার হয় আর অনেকে কোনো কারণ ছাড়াই। এখানে কোনো নিয়ন্ত্রণ নাই। পুলিশও কোনো সময় দেখি নাই যে বাধা দিছে। তারা একটু নজর দিলে মানুষ এভাবে জীবন হাতে নিয়া পার হতো না।’
মাথাপিছু ২ টাকা দিয়ে মই বেয়ে মানুষকে পারাপার করানো হচ্ছে সে বিষয়ে জানেন কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, 'মই দিয়া পার করানো দেখি নাই। তবে মাঝে মধ্যে রিকশা-ভ্যানের ওপর চইরা মহিলারা অনেক কষ্ট কইরা ডিভাইডার পার হয়। আর শিমুলতলায় ডিভাইডারের সঙ্গে বালুর বস্তা দিয়া রাখছে পার হওয়ার জন্য।'
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইনান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের শিক্ষার্থী সাইফুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রবলেম হচ্ছে শিমুলতলা থেকে সাভারের পাকিজা পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকায় চারটা লেন করছে। বেশিরভাগ লোকাল বাস যানজট বা যে কোনো কারণে এই কারণে বাম সাইডের লেন দিয়ে না ঢুকে পাশের লেন দিয়ে ঢুকছে। তখন অনেকেই বাধ্য হয়ে অনেক ঘুরে আসতে হবে বিধায় ঝুঁকি নিয়ে রাস্তার মধ্যেই নামছে। তারপর যে যার মতো ডিভাইডার টপকে পারাপার হচ্ছে।
‘এটা আসলে সেইফ না। তবে কর্তৃপক্ষ চাইলে মানুষ পারাপারের জন্য পয়েন্ট করে দিতে। যাতে মানুষের চলাচলের সুবিধা হয়।’
পোশাক কারখানার শ্রমিক কুলসুম বেগম বলেন, ‘নবীনগর থাইকা ঠিকানা বাসে সাভার আইছি নিউমার্কেট যামু। বাস রাস্তার ভিতরে নামায় দিছে। বাম দিক দিয়া ঢোকে নাই। তহন বাধ্য হইয়া ডিভাইডার পার হইছি। ভয়ও লাগছে, কষ্ট হইছে। তয় কী করার?
সাভার হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আজিজুল হাকিম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পুলিশ তো আর সব সময় বইসা থাকে না। যখন আমগো পুলিশ যায়, তখন সামনে পড়লে নিষেধ করি। এরপরে বিভিন্ন সময় রাস্তাঘাট পার হওয়ার জন্য সচেতনতামূলক আমরা মিটিং করি। এখন যদি আপনে নিজের ইচ্ছায় রোড ডিভাইডার লাফ দিয়া পার হইয়া হুইয়া পড়েন, এটা কি পুলিশ ফেরাইতে পারবে?
‘দুর্ঘটনা যাতে না হয় এজন্য ফুটওভার ব্রিজের পাশে অনেকটা জায়গা ধইরা উঁচু করে ডিভাইডার দিছে। অ্যারপরেও যদি আপনে যায়্যা লাফ দিয়া পার হন সেটা ফিরাইব কীভাবে?’
সাভার ট্রাফিক পুলিশের ইন্সপেক্টর (টিআই) আব্দুস সালাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটা কিন্তু আমি নিজের চোখেও দেখেছি। একটা জায়গায় না, একাধিক জায়গায় মানুষ ঝুঁকি নিয়ে পারাপার হচ্ছে। সাভার রানা প্লাজা এলাকা থেকে শিমুলতলা পর্যন্ত একাধিক জায়গাতে এরকম পারাপার হচ্ছে।
'এই মানুষদের বিরুদ্ধে কি আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারি? আমি তো বুঝি না এটা কী করা যাইতে পারে? আমরা তো আসলে মোটরযান আইনে যানবাহনকে জরিমানা করি। এর বিরুদ্ধে কোসনো আইন আছে আমি এটা খুঁজে পাই না।'
বাসচালকরা নিজেদের সুবিধার জন্য তাদের এমন জায়গায় নামিয়ে দিচ্ছে। যার ফলে বাধ্য হয়েই ডিভাইডার পার হচ্ছেন তারা- এমন অভিযোগের বিষয়ে টিআই সালাম বলেন, 'প্যাসেঞ্জার কেন ঝুঁকি নিয়ে নামবে? এখানে কিন্তু শুধু গাড়ি চালকদের দোষ না, ওই প্যাসেঞ্জারেরও অনেক দোষ আছে। কারণ, তার সুবিধামতো সে নামতে চায়। আপনি বাসে উঠলে খেয়াল করে দেখবেন, ওই প্যাসেঞ্জার গাড়িচালকদের জোর করে তার সুবিধামতো জায়গায় নামতে চায়।'
ঢাকা সড়ক ও জনপদ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী শামীম আল মামুন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এইটা কেউ ভায়োলেট করলে পুলিশ দেখবে। তাদের দায়িত্ব এটা। এটা নেগলেটের চেষ্টা করবে যারা তাদের এনফোর্সমেন্ট করবে পুলিশ।’