লাক্কাতুরা চা বাগান তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল।
নগর-লাগোয়া এই বাগানের ভেতরেই সিলেট ক্রিকেট স্টেডিয়াম। দেশের সবচেয়ে সুন্দর স্টেডিয়াম বলা হয় যাকে। এর পাশেই গলফ ক্লাব আর শেভরন পরিচালিত গ্যাসফিল্ড। দামি দামি গাড়ি যাওয়া-আসা করছে হরদম।
চারদিকে বৈভব আর উন্নয়নের প্রদর্শনী। কিন্তু বাগানের একটু ভেতরে ঢুকতেই এর ঠিক বিপরীত চিত্রের দেখা মেলে।
বাগানের ভেতর শ্রমিকরা যেখানে থাকেন, চা বাগানের ভাষায় এসব এলাকাকে বলা হয়- লেবার লাইন। ভাঙাচোরা, শীর্ণ একেকটা ঘর। আর ততোধিক শীর্ণ সেখানকার মানুষগুলো।
লাক্কাতুরা বাগানের লেবার লাইনে ঢুকতেই দেখা হলো সনকার সঙ্গে। এই সনকা চান সওদাগরের স্ত্রী নন, চা শ্রমিক। পুরো নাম সনকা মোদী। সনকা আফসোস করে বলেন, তাদের জাতভাই ইন্ডিয়ার রাজা আর তারা চা শ্রমিক।
সনকা তখন কেবলমাত্র ভাত খেয়ে উঠেছেন। কী দিয়ে খেয়েছেন?
মধ্যম আয়ের একটি দেশের একজন নাগরিক দুপুরে কেবল আলু ভর্তা আর পোড়া মরিচ দিয়ে ভাত খেয়েছেন। আর সকালে খেয়েছেন আটার রুটি ও লবণ চা।
সনকা তবু দুপুরে আলু ভর্তা আর ভাত খেতে পেরেছেন। পদ্মা গোয়ালার তাও জোটেনি। সকালে একটু ভাত খেয়েছিলেন। দুপুরে কিছুই খাননি। রাতে কী খাবেন তাও এখন পর্যন্ত জানেন না পদ্মা। আগের রাতেও উপোস কেটেছে তার। ঘরে খাবার না থাকলে খাবেন কী করে?
এমন করুণ অবস্থা প্রায় সব চা শ্রমিকের। নামমাত্র খেয়ে এবং না খেয়ে চলছে তাদের জীবন। মাত্র ১২০ টাকা মজুরিতে চলতে হয় তাদের।
কিন্তু এত দুরবস্থা কেন? কী করে তারা এলেন এখানে? কীভাবে হয়ে উঠলেন চা শ্রমিক?
এই প্রশ্ন করা হলো লাক্কাতুরার কয়েকজন চা শ্রমিককে। সহজ-সরল আর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবঞ্চিত এই মানুষগুলো উত্তর দিতে পারেননি। তারা কেউ জানেন না তাদের আদি নিবাস কোথায়; ভূমিপুত্র থেকে কীভাবে তারা হয়ে উঠলেন উদ্বাস্তু চা শ্রমিক।
চা বাগানে কী করে এলেন এই প্রশ্নের উত্তরে সবাই আশপাশের বিভিন্ন এলাকা বা অন্য চা বাগানের নাম বলেছেন।
এ অঞ্চলে চায়ের চাষ এবং চা বাগানে কাজ করার জন্য বিভিন্ন জায়গা থেকে শ্রমিক এনে জড়ো করার ইতিহাস পুরোনো, ঔপনিবেশিক আমলের।
চীনের ওপর নির্ভরশীলতা কাটাতে উনিশ শতকের শুরুর দিকে ভারতে চা চাষ শুরুর উদ্যোগ নেন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা।
অবিভক্ত ভারতের আসামে পাওয়া যায় চায়ের জাত। বাংলাদেশে প্রথম চায়ের চাষ শুরু হয় ১৮৪০ সালে, চট্টগ্রামে। আর ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনিছড়ায় প্রথম বাণিজ্যিক চা বাগান প্রতিষ্ঠা করা হয়।
প্রথমে চীন থেকে শ্রমিক এনে এখানে চাষ করা হতো চায়ের। কিন্তু কিছুদিন পর চীনা শ্রমিকরা কাজ করতে রাজি না হওয়ায় খোঁজা শুরু হয় স্থানীয় শ্রমিক। কিন্তু স্থানীয়রা এমন পরিশ্রমের কাজ করতে রাজি হননি।
এরপর ব্রিটিশ শাসকরা আশ্রয় নেন নতুন কৌশলের। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে তখন দুর্ভিক্ষ চলছে। নিরন্ন মানুষের হাহাকার।
এসব দুর্ভিক্ষপীড়িত এলাকার মানুষদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে নিয়ে আসা হয় চা বাগান তৈরির কাজে।
ইতিহাসবিদ সুকুমার বিশ্বাস ‘আসামে ভাষা আন্দোলন ও বাঙ্গালি প্রসঙ্গ ১৯৪৭-১৯৬১’ বইতে লিখেছেন, ‘ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে আসামে শ্বেতাঙ্গ চা-করেরা যখন চা-বাগান প্রতিষ্ঠা আরম্ভ করেন, তখন স্থানীয়ভাবে শ্রমিক না পাওয়ায় তারা আসাম সরকারের মাধ্যমে চা-শিল্পে কাজ করার জন্য ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজার হাজার শ্রমিক আনার ব্যবস্থা করেন।’
সুকুমার বিশ্বাস লিখেছেন- ‘বিহার, উড়িষ্যা, মাদ্রাজ, নাগপুর, সাঁওতাল পরগণা, মধ্যপ্রদেশ ও উত্তরপ্রদেশ থেকে নিয়ে আসা হয় এসব চা-শ্রমিকের।’
‘আসামে গাছ নাড়া দিলেই টাকা পড়ে’ এমন নানা মিথ্যে প্রলোভন ও প্রতারণার মাধ্যমে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সহজ-সরল ও ক্ষুধার্ত মানুষদের চা বাগানের কাজে আনা হয় বলে জানান ‘চা বাগানে মুক্তিযুদ্ধ’ গ্রন্থের লেখক ও গবেষক দীপঙ্কর মোহন্ত।
ক্রীতদাস প্রথা বিলুপ্ত হলেও এই শ্রমিকদের দাস হিসেবেই খাটানো হতো বলে জানান মোহন্ত।
ব্রিটিশ লেখিকা ক্যারোলাইন অ্যাডামস তার ‘সাত সমুদ্র তের নদীর ওপারে’ বইতে এই অঞ্চলে চা বাগানের উষালগ্ন সম্পর্কে লিখেছেন- ‘প্রথম দিকের বাগান মালিকেরা তাদের দুর্ব্যবহারের জন্য ছিলেন কুখ্যাত, মদ্যপ। বাগানগুলো অব্যবস্থাপনার শিকার এবং শ্রমিকেরা বঞ্চিত ও দুর্ব্যবহারের শিকার। ... বাগান শ্রমিকদের অত্যধিক খাটানো হতো, তাদের বাসস্থান নিম্নমানের এবং মজুরি ব্রিটিশ মালিকদের মুনাফার তুলনায় খুবই নগণ্য।’
২০০ বছরেও বাগানের এই চিত্রের কোনো পরিবর্তন হয়নি। এখনও স্বল্প মজুরিতে বেশি খাটানো হয় শ্রমিকদের। নেই ন্যূনতম সম্মান আর মৌলিক অধিকার। বরং তাচ্ছিল্য করে তাদের ডাকা হয় ‘কুলি’ বলে।
গালির মতো হয়ে ওঠা এই সম্বোধন নিয়ে আফসোস সনকার কণ্ঠে। আছে ক্ষোভও।
দেশের ১৬৭ চা বাগানের একটি লাক্কাতুরা। সিলেট শহরের উপকণ্ঠে বিমানবন্দর সড়কে এটি দেশের সবচেয়ে পুরোনো বাগানগুলোর একটি। এ বাগানের আরেক শ্রমিক শেলী মোদী। তার মেয়ে সুস্মিতা মোদীর কয়েক দিন ধরে শ্বাসকষ্ট। কিন্তু টাকার অভাবে মেয়েকে ডাক্তার দেখাতে পারছেন না শেলী। শ্রমিকদের বাগানের পক্ষ থেকে বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা দেয়া হয় বলে দাবি করেছেন বাগান মালিকরা। তবে শেলী জানান, বাগানে নামমাত্র একটি হাসপাতাল আছে। সেখানে কোনো সেবা পাওয়া যায় না। মেলে না ওষুধ ও চিকিৎসা সহায়তা।
এখানকার লাক্কাতুরা, মালনীছড়া, দলদলি চা বাগান ঘুরে দেখা গেছে, নামমাত্র একটি চিকিৎসাকেন্দ্র থাকলেও নেই তেমন কোনো ওষুধ। দলদলিতে নেই কোনো চিকিৎসকও। বেশির ভাগ বাগানেই কোনো চিকিৎসক নেই বলে জানিয়েছেন শ্রমিকরা। আর সব রোগের জন্য একটিই ওষুধ– প্যারাসিটামল।
এই একুশ শতকেও অসুখ-বিসুখে কবিরাজ আর ঝাড়ফুঁকই ভরসা এখানকার শ্রমিকদের। চিকিৎসার বদলে অপচিকিৎসার বলি হতে হয় তাদের।
চা বাগানের স্কুলগুলোর অবস্থাও নাজুক। বাগানে শিক্ষার সুযোগ বলতে কেবল প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত। বেশির ভাগ বাগানে সেটিও নেই। যেগুলোতে আছে সেগুলোতে শিক্ষক আছেন একজন কি দুইজন। প্রাথমিক পেরোলে পড়ালেখা শেষ।
মালনীছড়া চা বাগানের রাগীব-রাবেয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, স্কুলে শিক্ষার্থী উপস্থিতির হার খুবই কম।
মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে তখন আন্দোলন করছেন শ্রমিকরা। আন্দোলনের কারণেই উপস্থিতির হার কমেছে বলে জানালেন এখানকার শিক্ষক।
লাক্কাতুরা চা বাগানে একটি এনজিও পরিচালিত স্কুলে শিক্ষকতা করেন জেনি পাল।
সিলেটের চা বাগানগুলোর শিশুদের শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চায় উদ্বুদ্ধ করতে কাজ করে ঊষা নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোর বিকেলে খোলা উঠানে শিশুদের নিয়ে গান, নাচ ও আবৃত্তির ক্লাসের আয়োজন করে সংগঠনটি।
একদিন হাজির হই তাদের গানের ক্লাসে। উঠানে চাদর বিছিয়ে বসে আছে গোটা পঞ্চাশেক শিশু। সবার গায়েই ময়লা আর ছেঁড়া পোশাক। জীর্ণ শরীরের এসব শিশুর চোখে-মুখেও মলিনতার ছাপ।
আগন্তুকের অনুরোধে প্রথমে লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে পড়ে শিশুরা। পরে শিক্ষকের মধ্যস্থতায় লজ্জা কাটিয়ে গান ধরে তারা। শিশুরা যখন গেয়ে ওঠে... ‘এই বাগিচায় দুঃখে জনম যায় গো’।
মালনীছড়া চা বাগানের লেবার লাইন দিয়ে হাঁটার সময় দেখা হলো কয়েকজন শিশুর সঙ্গে। গোল হয়ে কাদামাটি দিয়ে খেলা করছে তারা। তাদের একজন রাকেশ ছত্রী। তার বাবা এই বাগানের শ্রমিক। একেবারে হাড় জিরজিরে শরীর রাকেশের। ভালো যে শরীরের ওপরে চামড়াটা আছে, না হলে তাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের অ্যানাটমি ক্লাসেই ব্যবহার করা যেত।
চা বাগানের বেশির ভাগ শিশু ভুগছে পুষ্টিহীনতায়। ভগ্ন স্বাস্থ্য তাদের। চা বাগানের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক জরিপে দেখা গেছে: অপুষ্টির কারণে বাগানের পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ৪৫ দশমিক ১ শতাংশ খর্বকায়, ২৭ শতাংশ শিশু শীর্ণকায় আর স্বল্প ওজনের শিশু আছে ৪৭ দশমিক ৫ শতাংশ। সারা দেশের তুলনায় চা বাগানে অপুষ্টির হার দ্বিগুণ।
এই জরিপেই দেখা গেছে, চা বাগানের ৬৭ শতাংশ পরিবার উন্নত স্যানিটেশন সুবিধা থেকে বঞ্চিত। আর ঘরেই সন্তান প্রসব করেন ৮০ শতাংশ নারী। প্রসূতিকালে ভালো খাবার বা চিকিৎসাসেবাও পান না তারা।
জরিপটি বছর চারেক আগের। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে এখন পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে বলে জানালেন শ্রমিকরা।
জরিপের এই করুণ দশার প্রমাণ পাওয়া গেল চা বাগানগুলো ঘুরেও। মালনীছড়া চা বাগানের শ্রমিক নমিতা লোহার সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। কিন্তু এখন পর্যন্ত একবারও ডাক্তারের কাছে যাওয়া হয়নি তার। এর আগে আরও দুটি সন্তান জন্ম হয়েছে নমিতার। দুবারই ঘরেই প্রসব হয়েছে। তাও প্রশিক্ষিত কোনো ধাত্রীর সহায়তা ছাড়া।
পাঁচ বছর ধরে চা বাগানের শিশুদের নিয়ে কাজ করছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ঊষা। এই সংগঠনের প্রধান সমন্বয়ক নিগার সাদিয়া জানান, অপুষ্টির কারণে চা বাগানের শিশুদের দৃষ্টিশক্তি ও স্মৃতিশক্তি অনেক কম। তারা কিছু মনে রাখতেও পারে না। এখানকার কোনো শিশুই তিন বেলা খেতে পারে না।
মা-বাবা কাজে থাকায় দুপুরে চা শ্রমিকদের ঘরে রান্নাবান্না হয় না। চা বাগানের প্রতিটি বিদ্যালয়ে শিশুদের জন্য মিড ডে মিল চালু করার কথা বলে আসছে সংগঠনটি।
বাংলাদেশ চা বোর্ডের হিসাবে, ২০২১ সালে দেশে রেকর্ড ৯ কোটি ৬৫ লাখ কেজি চা উৎপাদিত হয়, যার বাজারমূল্য প্রায় ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর আগে সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছিল ২০১৯ সালে। সে বছর ৯ কোটি ৬০ লাখ কেজি চা উৎপাদিত হয়েছিল। বাংলাদেশ বিশ্বের ৩ শতাংশ চা উৎপাদন করে। জিডিপিতে এই শিল্পের অবদান প্রায় ১ শতাংশ।
চায়ের উৎপাদন প্রতি বছর বাড়ছে। বাজার বড় হচ্ছে। বাড়ছে দাম। এতে লাভবান হচ্ছেন বাগান মালিকরা। তবে শ্রমিকদের জীবনে কোনো পরিবর্তন আসছে না। শ্রমিকরা থেকে যাচ্ছেন তিমিরেই।
বাগান মালিকদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় শ্রমিকদের রেশন, আবাসনসহ বিভিন্ন সুবিধা দেয়া হয়। শ্রমিকদের দাবি- এসব সুবিধা শুধু কাগজে-কলমেই। বাস্তব চিত্র ভিন্ন।
সিলেটের বিভিন্ন বাগান ঘুরে দেখা যায়, কয়েকজনের পাকা ঘর থাকলেও বেশির ভাগ শ্রমিকের ঘর জরাজীর্ণ। বাগানেই কিছু আলিশান বাড়ি আছে। এগুলোতে থাকেন ম্যানেজার আর পদস্থ কর্মকর্তারা। মালিকদের চাকচিক্যময় বাংলোও আছে কিছু বাগানে। সেখানে মাঝে মাঝে বেড়াতে আসেন তারা। শ্রমিকদের ঘরগুলো মাটি আর টিনের তৈরি।অনেকের ভাঙা ঘরে আলো আর বৃষ্টির জলের অবাধ যাতায়াত। শিয়াল-কুকুরও ঢুকে পড়ে অবাধে। ছাপড়ার মতো ছোট্ট একেকটা ঘরে ছেলে-মেয়ে, স্বামী-স্ত্রী, বাবা-মা মিলে থাকেন। একটি শয়নকক্ষেই পাঁচ-ছয়জনকে গাদাগাদি করে থাকতে দেখা গেছে।
শেলী মোদীর ঘর ঝড়ে ভেঙে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানানোর পর বাগান কর্তৃপক্ষ কিছু টিন দিয়েছে। কিন্তু কেবল টিন দিলেই কি ঘর মেরামত হয়? আনুষঙ্গিক অন্য জিনিস আর মজুর কোথায় পাবেন শেলী? এসব জোগাড় করতে না পারায় ঘরও মেরামত করা হচ্ছে না শেলীর।
ঘর ভেঙে পড়লেও এখন পর্যন্ত বাগান থেকে কোনো সহায়তা করা হয়নি বলে জানালেন আরেক শ্রমিক বিমল ভূমিজ।
মুজিববর্ষে ভূমিহীন সবাইকে ঘর করে দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। তবে এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত চা শ্রমিকরা। চা বাগানের কোনো শ্রমিকেরই ভূমির অধিকার নেই। নিজের জমি নেই। প্রায় ২০০ বছর ধরে বাগানে থাকলেও জমির মালিকানা পাননি তারা।
চা শ্রমিকের সন্তান কাজল গোয়ালা। অনেক কষ্টে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন তিনি। চা বাগানে কাজলদের একটা সাংস্কৃতিক দলও আছে।
কাজলের আক্ষেপ, দাস হিসেবেই থাকতে হচ্ছে তাদের। কেউ কাজ না করলে বাগানে থাকতে দেয়া হয় না।
চা বাগানের বাসিন্দাদের বেশির ভাগই হিন্দু ধর্মাবলম্বী। মুসলমান আর খ্রিষ্টানও আছেন কিছু। মুসলমানরা মূলত এসেছেন বিহার থেকে। আর এখানে আসার পর ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিষ্টান হয়েছেন অনেকে। চা বাগানে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষজন থাকলেও তাদের এখন একমাত্র পরিচয় চা শ্রমিক। হারিয়ে গেছে নিজেদের জাতিগত পরিচয়।
গবেষক দিলীপ গাইন তার ‘স্লেভ ইন দিস টাইমস: টি কমিউনিটি অফ বাংলাদেশ’ গ্রন্থে বলেছেন, চা বাগানগুলোতে ৮০টি ক্ষদ্র জাতিগোষ্ঠীর বসবাস।
চা শ্রমিকদের সংস্কৃতি নিয়ে পিএচডি করেছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আশ্রাফুল করিম। তিনি জানান, ক্ষুদ্র্র নৃগোষ্ঠী হয়েও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত চা শ্রমিকরা।
চা বাগানের নৃগোষ্ঠীগুলোর রয়েছে সমৃদ্ধ সংস্কৃতি। তবে চর্চার অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে তা। সিলেটের চা বাগানগুলোতে একমাত্র দুর্গাপূজা জাঁকজমক করে আয়োজন করা হয়। কিন্তু চা শ্রমিকদের নিজস্ব ফাগুয়া উৎসব সেভাবে পালন হয় না। চর্চার কোনো সুযোগ না থাকা আর অর্থাভাবে এসব জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন কাজল।
কয়েক দিন আগেও চা শ্রমিকরা দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে ধর্মঘট পালন করছিলেন। বাগান মালিকদের দাবি, বিভিন্ন সুবিধা মিলিয়ে দিনে একজন শ্রমিক ন্যূনতম ৪০২ টাকা আয় করেন।
তবে মালিকদের এই দাবির সঙ্গে ভিন্নমত শ্রমিকদের। তারা জানান, ঘরের পাশে একটি সবজির গাছ লাগালেও মজুরি বা রেশন থেকে কেটে রাখে বাগান কর্তৃপক্ষ। আর কাজে না গেলে মজুরি বা রেশন মেলে না।
অনেক বাগানের শ্রমিকরা ১২০ টাকা মজুরিও পান না বলে জানালেন গবেষক ড. আশ্রাফুল করিম।
শ্রম আইন অনুযায়ী অবসরে যাওয়া শ্রমিকদের অবসরকালীন ভাতা দেওয়ার বিধান থাকলেও তারা এমন কিছু পান না বলে জানিয়েছেন চা বাগানে কাজ করে অবসরে যাওয়া কয়েকজন।
এত বঞ্চনা, এত অপ্রাপ্তি তবু বংশপরম্পরায় চা বাগানেই থেকে গেছেন শ্রমিকরা। চা শ্রমিকদের সন্তানদের মধ্যে বাগানের বাইরে কাজে যাওয়ার প্রবণতা কম। শহরের আশপাশের বাগানগুলোর শ্রমিক পরিবারের কেউ বাইরে কাজ করলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই হার একেবারেই কম।
গবেষক দীপঙ্কর মোহন্ত জানান, শুরু থেকেই চা শ্রমিকদের মূল জনগোষ্ঠী থেকে আলাদা করে রাখার উদ্যোগ নিয়েছিলেন ব্রিটিশ শাসকরা। কেননা, মূল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশলে শ্রমিকরা অধিকার সচেতন হয়ে উঠবেন। নিজেদের বঞ্চনা উপলব্ধি করতে পারবেন। তখন বাগানে কাজ করতে চাইবেন না।
এমনকি শ্রমিকদের বিচ্ছিন্ন রাখতে বাগানে আলাদা মুদ্রা ব্যবস্থা চালু করে ব্রিটিশরা। বাগানে বাইরের মানুষের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করা হয়। শ্রমিকদের চলাচলও সীমিত করা হয়।
দীর্ঘকাল ধরে বিচ্ছিন্ন থাকতে থাকতে তাদের মানসিকতাই বদলে গেছে। এখনও তারা বাইরের মানুষের সঙ্গে মিশতে পারছেন না। বাগানকেই তাদের জীবন মনে করছেন।
আর চা শ্রমিকের সন্তান কাজল গোয়ালা মনে করেন, অর্থাভাবে লেখাপড়া শিখতে না পারার পাশাপাশি চা শ্রমিকদের বাগানের বাইরের মানুষরা অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখার কারণেও তারা সমাজের মূল স্রোতে মিশতে পারছেন না।
ছিলেন দরিদ্র কৃষক। প্রলোভন আর প্রতারণার শিকারে হয়ে গেলেন দাস। নামমাত্র মজুরিতে, কখনওবা মজুরি ছাড়াই কঠোর শ্রম দিয়ে যেতে হয়। গহিন জঙ্গল পরিষ্কার করে গড়ে তোলেন চা বাগান। এমন কঠোর পরিশ্রম আর অনাহার ও অর্ধাহারে মারা যান অনেকে।
এই বঞ্চনা আর প্রতারণার বিরুদ্ধে একবারই সম্মিলিতভাবে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন চা শ্রমিকরা। ১৯২১ সালে সবাই মিলে নিজেদের আদি নিবাসে ফিরে যাওয়ার উদ্যোগ নেন তারা। বিভিন্ন বাগান থেকে বাইরে বেরিয়ে আসেন শ্রমিকরা। তাদের ঠেকাতে সেবার ব্রিটিশ সরকার রেলসহ সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল। শ্রমিকরা তবু হেঁটেই রওনা দেন। মাইলের পর মাইল হাঁটতে থাকেন তারা। পথেই মারা যান অনেকে। তবু দৃঢ় সংকল্প শ্রমিকরা। তাদের দমাতে না পেরে আরও কঠোর হয়ে ওঠে ব্রিটিশ সরকার।
১৯২১ সালের ২০ মে চাঁদপুরের জাহাজঘাটে বাড়ি ফেরার জন্য জড়ো হন চা শ্রমিকরা। এ সময় তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে গোরখা সৈন্যরা। সরিয়ে নেওয়া হয় জাহাজের পাটাতন। বহু শ্রমিকের সলিল সমাধি ঘটে। সেবার আর বাড়ি ফেরা হয়নি তাদের। আর কখনই বাড়ি ফেরার সাহস করেননি তারা।
চা বাগানগুলোকে আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক হিসেবে ধরা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শ্রমিকদের কাছে দেবতাতুল্য। বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগেই ১৭৭০-এর নির্বাচনে ভোটাধিকার পান চা শ্রমিকরা। এর আগে তাদের ভোটের অধিকারও ছিল না।
১৯৫৬ সালে শ্রম সচিব থাকাকালে চা শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি ও বোনাস নির্ধারণ করে দেন বঙ্গবন্ধু। আর ১৯৫৭ সালে টি বোর্ডের দায়িত্ব নিয়ে শ্রমিকদের জন্য রেশনের ব্যবস্থা চালু করেন তিনি।
এই কৃতজ্ঞতা বোধ থেকেই চা শ্রমিকরা বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের অনুসারী।
দিনের কর্মব্যস্ত চা বাগানের বিপরীত চিত্র রাতে। রাতের বাগান একেবারে সুনসান। বাইরে যদিও তীব্র গরম, তবে রাতের চা বাগানে শীত নামতে শুরু করেছে। বাতাসে শীতের মিষ্টি ঘ্রাণ।
রাতে যখন দলদলি চা বাগানে ঢুকি, বাগানের প্রবেশমুখে দেখা যায় অট্টালিকাসম একটি ভবনের নির্মাণকাজ চলছে। শ্রমিকরা জানালেন, ইসকনের মন্দির তৈরি হচ্ছে এখানে। নিজেরা যদিও ছাপড়া ঘরে থাকেন, তবু চাঁদা তুলে মন্দিরের জন্য সুরম্য ভবন বানাচ্ছেন তারা। প্রতিটি বাগানেই আছে সুরম্য মন্দির। মসজিদ আর গির্জাও আছে অনেক বাগানে। মালনীছড়া বাগানের পাশাপাশিই রয়েছে মন্দির, মসজিদ ও গির্জা। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান।
চা বাগানগুলোতে রয়েছে মদের পাট্টা। রাত হলেই অনেক শ্রমিক ভিড় করেন সেখানে। কম দামে অস্বাস্থ্যকর বাংলা মদে বুঁদ হয়ে থাকেন তারা। শ্রমিকদের বিভিন্ন বাড়িতেও বিক্রি হয় মদ। কম পারিশ্রমিকে অধিক কাজ করানোর জন্য ব্রিটিশরাই বাগানে এসব মদের দোকান চালু করে। প্রথমদিকে শ্রমিকদের জোর করেই মদ খাওয়ানো হতো। মদপানে উৎসাহ দেয়া হতো।
দলদলিতে বাগানে ঢুকতেই একটি ঘর থেকে ভেসে এলো কীর্তনের সুর। হরিনামসংকীর্তন চলছে। একটু সামনে এগোতেই শোনা গেল মদ নিয়ে দুই শ্রমিকের হল্লা। বঞ্চনা আর যন্ত্রণা ভোলার বাহারি সব আয়োজন।
এসবে ভুলেই চা পাতার মতো সবুজ আর ঘ্রাণময় এই মানুষগুলো বংশপরম্পরায় কাটিয়ে যাচ্ছেন ক্রীতদাসের জীবন। নিজেদের ঘাম আর রক্তে টিকিয়ে রেখেছেন দুটি পাতা একটি কুড়ির চা শিল্পকে। সবার ঘরে পৌঁছে দিচ্ছেন প্রতিদিনকার আবশ্যিক পানীয় চা।
গরম চায়ে চুমুক দিয়ে সতেজ হয়ে ওঠা মানুষরা কতটুকুইবা জানে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের দুঃখের কথা?