মেয়েদের পোশাকের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কর্মসূচি নিয়ে তোলপাড়ের মধ্যে এবার পোশাকের বৈচিত্র্যকে স্বাগত জানিয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী।
এতে বেসরকারি ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি এবং ভিকারুননিসা নূন স্কুলের কয়েকজন শিক্ষার্থীও অংশ নেন।
তারা যার যেমন খুশি তেমন পোশাক পরে কর্মসূচিতে অংশ নেন। আয়োজনের নামও দেয়া হয় ‘যেমন খুশি তেমন পরো’।
আয়োজকরা বলছেন, বৈচিত্র্যময় এবং অযাচিত খবরদারিহীন বাংলাদেশের প্রতিরূপ তুলে ধরতেই তাদের এই আয়োজন।
বৃহস্পতিবার বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে এই কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীরা পোশাকের স্বাধীনতা নিয়ে বিভিন্ন লেখা সংবলিত প্লাকার্ড বহন করেন।
প্লাকার্ডগুলোতে ‘সংস্কৃতি কারও বাপের না’, ‘শান্তিপূর্ণ দাসত্বের উপরে প্রশ্নবিদ্ধ স্বাধীনতা বেছে নিলাম’, ‘কয়দিন পর যদি নাম শুনেই সিডিউসড হয়ে যান’, ‘সিডিউসড হোন বা না হোন হামলে পড়বেন না’, ‘আমি বলি না নিপাত যাক, বলি সব থাক থাক’ ইত্যাদি লেখা ছিল।
কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের শিক্ষার্থী খাদিজা শারমিন বলেন, ‘যারা পোশাকের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে রাজু ভাস্কর্যে দাঁড়িয়েছিল, তারা বলেছে স্বাধীনতার নামে আমরা যারা ইচ্ছেমতো পোশাক পরতে চাই, আমাদের যেন আইনের আওতায় আনা হয়।
‘কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধান বাঙালি নারী হিসেবে আমার কাছে যেটা শালীন মনে হয় সেটা পরার অধিকার দিয়েছে। কিন্তু যারা এখানে দাঁড়িয়েছিল এবং পরে তাদের প্রভাবে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে দাঁড়িয়েছিল তারাই সংবিধানবিরোধী কথা বলছে। তারা আমাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছে। তাদেরকেই আইনের আওতায় আনা উচিত।’
সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী অরুণিমা তাহসীন বলেন, ‘শাড়ি, লুঙ্গি, পাজামা-পাঞ্জাবি, সালোয়ার-কামিজ, স্কার্ট, ওয়েস্টার্ন, বোরকা, থামিসহ সব আদিবাসী পোশাক আমাদের পোশাক। নিজের চোখে যে পোশাক মানানসই, তার ব্যতিক্রম অন্যের পোশাকে দেখলে আক্রমণের যে প্রবণতা শুরু হয়েছে তার বিরুদ্ধে আমরা।’
‘নিজের পছন্দকেই দেশীয় মূল্যবোধের সর্বোচ্চ স্ট্যান্ডার্ড ধরা, আর এদেশেরই আরেকজন স্বাধীন নাগরিকের পছন্দকে খারিজ করে দেয়ার যে নাৎসিবাদী প্রবণতা, তার বিরুদ্ধেই আমাদের আজকের আয়োজন।’
লিখিত বক্তব্যে আয়োজকরা বলেন, ‘যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ তৈরির সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই কিছু শিক্ষার্থীকে পোশাকের স্বাধীনতা তথা জীবনযাপনের স্বাধীনতার ওপর আক্রমণকে সাধুবাদ জানাতে দেখা লজ্জার বিষয়।’
‘মূল্যবোধ এবং সংস্কৃতি সদা পরিবর্তনশীল। অন্যের স্বাধীনতার ওপর খবরদারি না করে, নিজের স্বাধীনতা চর্চার মাধ্যমে সমাজে যে পরিবর্তন আসে, তার পক্ষে আমাদের অবস্থান। ব্যক্তি-স্বাধীনতার অভিব্যক্তি যত শক্তিশালী হচ্ছে, সমাজ তত বৈচিত্র্যময় হচ্ছে। এই বৈচিত্র্যে যেমন রয়েছে ধর্মীয় পোশাক, ততটাই রয়েছে তথাকথিত পাশ্চাত্য পোশাক।’
একটির বিরুদ্ধে অন্যটিকে ব্যবহার করা ও তার মাধ্যমে এদেশের একজন স্বাধীন নাগরিককে হেনস্তা করা এবং তার ফলাফলে স্বাধীনতার উল্টো ‘ভয়ের সংস্কৃতি’ তৈরি করা- এই পুরো প্রক্রিয়ার তীব্র নিন্দাও জানান আয়োজকরা। বলেন, ‘এর বিপক্ষে দাঁড়িয়ে আমরা পোশাকের বৈচিত্র্য চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাতে চাই।’
কর্মসূচিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের তাসনিম হালিম মিম, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের রাফিয়া তামান্না, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ওয়াসিমা ফারজানা, সাইমা লুবনা এবং ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্র ফাইজা ফাইরুজও অংশ নেন।
যে ঘটনার প্রতিবাদ
২৫ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী ‘মূল্যবোধবিরোধী’ পোশাকের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করেন।
স্লিভলেস টপস পরার কারণে নরসিংদীর রেলওয়ে স্টেশনে এক নারীকে হেনস্তার অভিযোগে আটক নারীর জামিন শুনানিতে হাইকোর্টে একজন বিচারক যে মন্তব্য করেছেন, তার প্রতি সমর্থন জানিয়ে মানববন্ধন করেন তারা। তারা পোশাকের নামে পশ্চিমা ‘অপসংস্কৃতি’ আমদানিকারকদের আইনের আওতায় এনে বিচারের দাবিও তোলেন।
ওই কর্মসূচিতে ‘দেশীয় মূল্যবোধবিরোধী’ পোশাকের বিরুদ্ধে ‘সোচ্চার’ হওয়ায় উচ্চ আদালতকে অভিবাদন ও স্যালুট জানানো হয়।
শিক্ষার্থীরা ‘দেশীয় মূল্যবোধবিরোধী সংস্কৃতি গ্রহণযোগ্য নয়’, ‘পোশাকের স্বাধীনতার নামে পাবলিক নুইসেন্স বন্ধ হোক’, ‘ছোট পোশাক নারীকে বিজ্ঞানী বানায় না, পণ্য বানায়’ ইত্যাদি লেখাসংবলিত প্লাকার্ড প্রদর্শন করেন।
পোশাকে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ঢাবিতে যে মানববন্ধন হয়েছিল। ছবি: নিউজবাংলা
পোশাকের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন কর্মসূচি মানুষকে যেমন বিস্মিত করে, তেমনি সমালোচনাও হয়।
বেসরকারি নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং কুষ্টিয়ায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়েও একই ধরনের কর্মসূচি পালন করা হয়।
এর মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পাল্টা কর্মসূচিও পালিত হয়, যেখানে পোশাকের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারীদের কটাক্ষ করা হয়।