করপোরেট ঋণচুক্তির আওতায় ১৩০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ‘চক্রবৃদ্ধির’ খাঁড়ায় পড়েছেন হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (হাবিপ্রবি) চার শতাধিক শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী। চুক্তির সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বরত কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে তাদের বর্ধিত হারে ঋণের সুদ টানতে হচ্ছে।
২০১৮ সালের ১৮ মার্চ দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় শাখা রূপালী ব্যাংকের মধ্যে ২০০ কোটি টাকার করপোরেট ঋণচুক্তি হয়। চুক্তির ২০০ কোটি টাকার মধ্যে ১৩০ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে গ্রহণ করে হাবিপ্রবি কর্তৃপক্ষ। পরে সেই টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চার শতাধিক শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ঋণ হিসেবে দেয়া হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে ব্যাংকে সেই ঋণের টাকার সুদ বেশি পরিমাণে দিতে হচ্ছে শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।
চুক্তির আগে শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জানানো হয়, ঋণে সুদের হার সরল হিসেবে ৯ শতাংশ দিতে হবে। অথচ ‘চক্রবৃদ্ধি’ হারে কিস্তি আদায় করা হয়েছে। বিষয়টি তখন ঋণগ্রহীতাদের জানানো হয়নি। ২০১৮ সালের মার্চ মাসের পর থেকে অদ্যাবধি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ঋণ পরিশোধ করে এসেছেন সরল সুদ হিসেবে। আর ব্যাংক তা হিসাব করেছে চক্রবৃদ্ধির হিসাব ধরে।
সম্প্রতি রুয়েটে একই ব্যাংকের একই নিয়মের ৬০ কোটি টাকার ঋণের কাগজপত্র যাচাই করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এই কারচুপি দেখতে পান। রুয়েটের ঋণের কিস্তি ৯ শতাংশ সরল সুদে আদায় করা হচ্ছে। অথচ হাবিপ্রবিতে ৯ শতাংশ চক্রবৃদ্ধি হারে আদায় করেছে ব্যাংকটি। দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একই ব্যাংকের দুই নিয়মে ঋণ আদায় করা নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব শাখা সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালের ১৪ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় ও রূপালী ব্যাংকের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার মধ্যে ২০০ কোটি টাকার ঋণচুক্তি হয়। তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে তৎকালীন রেজিস্ট্রার প্রফেসর ড. সফিউল আলম ও রূপালী ব্যাংক বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ব্যবস্থাপক পবিত্র কুমার রায় স্বাক্ষর করেন।
ওই সময় মোট ৪০৪জন মোট ১৩০ কোটি টাকার ঋণ নেন। তাদের মধ্যে শিক্ষক ১০৫, কর্মকর্তা ১০৮ ও কর্মচারী ১৯১ জন।
ঋণ দেয়ার সময় গ্রহীতাদের জানানো হয়, ৯ শতাংশ সরল সুদে ১৮০টি কিস্তির মাধ্যমে ১৫ বছরে এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এতে করে প্রতি মাসে প্রতি লাখ টাকায় ১০১৫ টাকা করে ইএমআই (ইক্যুয়াল মান্থলি ইনস্টলমেন্ট) দিতে হবে।
ইতোমধ্যে ঋণ নেয়ার ৫২ মাস পার হয়েছে। এর মধ্যে ৩৭ মাসের কিস্তি পরিশোধ করা হয়েছে। মাঝখানে করোনার সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার হিসেবে ১৫ মাসের ইএমআই দেয়া হয়নি।
জুলাই মাসে ঋণ গ্রহীতারা ব্যাংকের কাছে জানতে চান যে মূল ঋণের কত টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। জবাবে ব্যাংকের দেয়া তথ্যে তারা গরমিল দেখতে পান। পরে তারা জানতে পারেন যে, তাদের ৯ শতাংশ সরল সুদ নিয়মে যে ঋণ দেয়া হয়েছে তা চক্রবৃদ্ধি বা অন্য উপায়ে নেয়া হচ্ছে।
ঋণ গ্রহীতারা বিষয়টি জানানোর পর রূপালী ব্যাংককে চিঠি দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ইতোমধ্যে বিষয়টি রূপালী ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকেও অবহিত করা হয়। পরে রূপালী ব্যাংক বিষয়টি সমাধানের আশ্বাস দেয়।
ঋণগ্রহীতা তিন শিক্ষক প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘একই ঋণ দুটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুটি নিয়মে কেন আদায় করা হবে। তারা আমাদের অন্ধকারে রেখে ঋণ আদায় করেছে। এখানে চুক্তির আগে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের গাফিলতি ছিল। এ পর্যন্ত প্রতিজন ঋণগ্রহীতা ৩৭ মাস কিংবা তারও বেশি কিস্তি (ইএমআই) পরিশোধ করেছেন। এসব ইএমআইয়ে অতিরিক্ত অর্থ আদায় হয়েছে তা সমন্বয় করতে ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
সাবেক প্রক্টর প্রফেসর ড. সফিকুল ইসলাম বলেন, 'আমরা যারা ঋণ নিয়েছি, তাদের কাছ থেকে সরল সুদের বিনিময়ে অন্যভাবে ইএমআই নেয়া হয়েছে। অতিরিক্ত যে অর্থ আমাদের কাছ থেকে আদায় করা হয়েছে তা যাতে করে সমন্বয় করা হয়, এজন্য আমরা আবেদন করেছি। যদিও এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।
রেজিস্ট্রার প্রফেসর ড. সাইফুর রহমান বলেন, চুক্তিতে সরল সুদ বা চক্রবৃদ্ধি কথাটি ছিল না। যারা ওই সময়ে চুক্তি করেছিলেন তাদের এটি দেখার কথা। চক্রবৃদ্ধি হারে যে টাকা প্রথম থেকে নেয়া হয়েছে তা সমন্বয় করতে ব্যাংককে চিঠি দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ৯ শতাংশ সরল সুদ থেকে ৮ শতাংশ সরল সুদ করার জন্যও বলা হয়েছে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালক (হিসাব) মিজানুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সার্কুলারের ভিত্তিতে করোনার কারণে আমরা ১৫টি কিস্তি দেইনি। অথচ রূপালী ব্যাংক ১৫ মাসের ইএমআই মূলধনের সঙ্গে যুক্ত করেছে। এটি হলে রূপালী ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অমান্য করেছে।’
রূপালী ব্যাংক হাবিপ্রবি শাখার ব্যবস্থাপক গৌতম চন্দ্র রায় বলেন, ‘হাবিপ্রবি কর্তৃপক্ষ চুক্তিটি সংশোধনের আবেদন করেছে। আমরা তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে পাঠিয়ে দিয়েছি। ২০১৮ সালের মার্চ মাসের চুক্তির সময়ে আমি দায়িত্বে ছিলাম না। তাই এ ব্যাপারে বিস্তারিত বলতে পারছি না।‘
ওই সময়ে দায়িত্বরত ব্যাংকের ব্যবস্থাপক পবিত্র কুমার রায় বলেন, ‘ওই সময়ে যে চুক্তি হয়েছে তা চক্রবৃদ্ধি হারেই হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। এখন চক্রবৃদ্ধি হারে সুদের ঋণের অর্থ সরল সুদের কথা বলে দেয়া হয়েছে এই দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের। সেই সময়ে যারা দায়িত্বে ছিলেন বিষয়টি তাদের।’
ওই সময়ে দায়িত্বরত রেজিস্ট্রার প্রফেসর ড. সফিউল ইসলাম ইতোমধ্যে মারা গেছেন। সেই সময় থেকে অদ্যাবধি দায়িত্বে আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিট শাখার উপ-পরিচালক মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন। কথা হলে তিনি চুক্তিটি সরল সুদে নাকি চক্রবৃদ্ধি হারে ছিল তা জানাতে পারেননি।
তিনি বলেন, ‘চুক্তিপত্র দেখতে হবে, চুক্তিপত্র আমার কাছে নাই। সমস্যা আছে সমাধান হবে। বিষয়টি ব্যাংক আর বিশ্ববিদ্যালয় সমাধান করবে। এখন আপাতত নিউজ করার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন হলে আপনাদের দারস্ত হব।’
ওই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব শাখার পরিচালক অধ্যাপক ড. শাহাদৎ হোসেন খান জানান, সে সময়ে চুক্তির কোনো কিছুতে আমাকে রাখা হয়নি। আমি পরিচালক থাকলেও আমাকে অন্ধকারে রাখা হয়েছিল। আমাকে চুক্তি দেখতেও দেয়া হয়নি।’