ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগকে নিয়ে সংবাদমাধ্যমে যেসব নেতিবাচক খবর আসে, তার দায় 'আলতুফালতু' লোকদের বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তার ভাষ্য, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় এবং ছাত্রলীগ বড় সংগঠন হওয়ার সুযোগে অনেক আলতুফালতু লোক সংগঠনে ঢুকে ‘গোলমাল’ করায় বদনাম হচ্ছে।
রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বুধবার সকালে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে ছাত্রলীগের আলোচনায় প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
বক্তব্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শান্তি নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের পেছনে তো লোক লেগেই আছে, লেগেই থাকবে।’
এমন বাস্তবতায় ছাত্রলীগকে সাবধান থাকতেও বলেছেন সরকারপ্রধান।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি জানি, ছাত্রলীগ সম্পর্কে অনেক অনেক কথা লেখা হয়। এত বড় একটা সংগঠন; তার মধ্যে কিছু কিছু তো…আমরা ক্ষমতায় আছি বলে অনেকে ভেতরে ঢুকে যায়; ঢুকে নিজেরাই গোলমাল করে। বদনামটা ছাত্রলীগের ওপর পড়ে।
‘ছাত্রলীগকেও সংগঠন করার সময় ওই গ্রুপ বানানোর জন্য এই রকম আলতুফালতু লোক দলে ঢোকাবে না। তাতে নিজেদের বদনাম, দলের বদনাম, দেশের বদনাম।’
তিনি বলেন, ‘পেছনে তো আমাদের লোক লেগেই আছে, লেগেই থাকবে। ছাত্রদল যত অপকর্ম করে গেছে, সেটা নিয়ে কথা নেই, কিন্তু ছাত্রলীগের একটু হলেই বড় নিউজ, কিন্তু নিজেদের ঠিক থাকতে হবে।’
আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেয়ার বিষয়টি সামনে আনেন তার কন্যা।
ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘একজন রাজনৈতিক নেতা তিনি কিন্তু মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিচ্ছেন সংগঠন করার জন্য। এটা কত বড় একটা ত্যাগ স্বীকার, সেটা তোমাদের মনে রাখতে হবে। তার কারণ আমরা দেখি দল ছেড়ে আসে মন্ত্রিত্ব পাওয়ার জন্য। আর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তিনি কিন্তু মন্ত্রিত্ব ছেড়েছিলেন সংগঠনটাকে শক্তিশালী করার জন্য।’
বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের শেখ হাসিনা বলেন, ‘চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে উঠে ত্যাগ স্বীকার করে এগোতে পারলে সঠিক নেতা হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলা যায়, কিন্তু গড্ডলিকা প্রবাহের মতো অর্থ-সম্পদের পেছনে ছুটলে, ওই অর্থ সম্পদে ভেসে যেতে হয়; নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা থাকে না, দেশকেও কিছু দেয়া যায় না, মানুষকেও দেয়া যায় না।’
করোনাকালে, দুর্যোগে কৃষকের ধান কেটে দেয়ায় ছাত্রলীগকে ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘মানবিকতার পাশাপাশি যেটা সব থেকে বেশি দরকার, লেখাপড়া শিখতে হবে। আজকে ডিজিটাল বাংলাদেশ করে দিয়েছি। আধুনিক প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন আমি দক্ষ জনশক্তি চাই। কারণ চতুর্থ শিল্পবিপ্লব আসবে। তার উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে আমাদের আজকের প্রজন্ম বা প্রজন্মের পর প্রজন্মকে প্রস্তুত করবে।
‘এখন প্রযুক্তির যুগ, তথ্যপ্রযুক্তির যুগ, বিজ্ঞানের যুগ। এরই সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষায়দীক্ষায় উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে হবে। সেভাবে নিজেদের তৈরি করতে হবে। কারণ দেশ চালাতে গেলে শিক্ষার প্রয়োজন আছে। দেশ চালাতে গেলে জ্ঞানের প্রয়োজন আছে। ইতিহাস জানা প্রয়োজন আছে। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হতে হবে।’
আর সেটা না থাকলে কোনো দিন দেশের উন্নতি হবে না বলে মনে করেন সরকারপ্রধান।
শিক্ষার উন্নয়নে সরকারের নেয়া নানা পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কাজেই শিক্ষার পরিবেশ যেন বজায় থাকে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যাতে শান্তিতে থাকে।’
অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশের উন্নয়নে কাজ শুরু করেছে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘অন্তত বাংলাদেশের একটা উন্নতি আমরা করতে পেরেছি। আজকে উন্নয়নশীল দেশে আমরা উন্নীত করতে পেরেছি, যেটা জাতির পিতা স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে রেখে গিয়েছিলেন, কিন্তু আমাদের অনেক দূর যেতে হবে। পরিকল্পনা করে দিয়ে যাচ্ছি আমি।
‘২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ কেমন হবে, ২১০০ সালের ডেল্টা প্ল্যান, সেটাও প্রণয়ন করে দিয়েছি। কাজেই যারা আগামী দিনে আসবে, তারা এটা অনুসরণ করলে এই বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা আর কেউ থামাতে পারবে না।’
মন্দাকালে সাশ্রয়ী হতে হবে
করোনা মহামারির অভিঘাত ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক মন্দা সম্পর্কে সবাইকে সতর্ক থাকার কথাও বলেন প্রধানমন্ত্রী। বৈশ্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরে সাশ্রয়ী হওয়ার আহ্বান ছিল তার কণ্ঠে।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘বিদ্যুৎ যেন সীমিত আকারে ব্যবহার, যেটুকু লাগবে সেটুকু, না হলে সুইচ অফ করে দিতে হবে। পানি ব্যবহার, সেখানেও মিতব্যয়ী হতে হবে। ওই কল ছেড়ে রেখে, ঝরনা ছেড়ে রেখে গোসল করা চলবে না।
‘সবাইকে বালতি কিনে মগে করে পানি ব্যবহার করতে হবে। এক ফোঁটা পানি যেন অপচয় না হয়। পানির জন্য হাহাকার, উন্নত দেশগুলোতে হাহাকার।’
জ্বালানি সাশ্রয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, ‘অহেতুক ঘোরাঘুরি করার দরকার নেই। পায়ে হাঁটলে স্বাস্থ্য ভালো থাকে।’
বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দায় উন্নত দেশগুলো হিমশিম খাচ্ছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের আগে থেকেই সতর্ক থাকতে হবে। ওদের অবস্থায় যেন আমাদের পড়তে না হয়।’
তিনি বলেন, ‘বিশ্বে আরও ভয়াবহ অবস্থা হবে, পয়সা দিয়েও খাবার কেনা যাবে না। সে ক্ষেত্রে আমাদের নিজেদের খাবার নিজেদের উৎপাদন করতে হবে। ছাত্রলীগ ধান কাটায় যেমন সাহায্য করেছে, ধান রোপণেও সাহায্য করবে।’
স্মৃতিচারণা
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে উঠে আসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান, যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা ও হত্যা-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতির নানা দিক।
বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকার সময় বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত ও বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে একাগ্রতার কথাও তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, ‘সেই গেরিলা কায়দায় তিনি যে বের হতেন, দেখা করতেন ইন্টেলিজেন্সের লোকেরা, কখনও ধরতেই পারেনি। কখনও এই খোঁজটা নিতেই পারেনি তারা। এটাই ছিল আমার মায়ের বড় একটা সাফল্য।’
তিনি বলেন, ‘আমার মায়ের আরেকটা মেকানিজম ছিল। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে কোথায় কী ঘটছে, সব খবর কিন্তু তার কাছে চলে আসত। তখন কিন্তু মোবাইল ফোন ছিল না; কিছু ছিল না, কিন্তু আওয়ামী লীগের এমন একটা নেটওয়ার্ক ঢাকা মহানগরে ছিল, কোনো খবর কোথাও হলে সঙ্গে সঙ্গে মায়ের কাছে চলে আসত।’
সংসার করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর আন্দোলন, সংগ্রামময় জীবনে বঙ্গমাতা কখনও বাধা হয়ে দাঁড়াননি বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘সংসারে একটা জিনিসের জন্য তোলপাড় হয়ে যায়। কিন্তু আমার মা আমার বাবাকে কোনো দিন বিরক্ত করেনি, কিন্তু আমাদের জাতীয় জীবনে, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে, আমাদের মুক্তি, আমাদের বিজয়ে আমার মায়ের যে সময়োচিত সিদ্ধান্ত, এই যে সময়োচিত সিদ্ধান্ত নেয়া এবং তার জন্য আজকে আমাদের বিজয় অর্জন। একাত্তর সালে মাকে তো গ্রেপ্তার করে রেখেছিল।
‘কখনও সে হতাশ হয়নি। মার একটা আত্মবিশ্বাস ছিল, দেশ স্বাধীন হবেই। সব সময় তার কাছেই এটা পেয়েছি, বন্দিখানায়ও।’