গত বছর দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সেবা নিতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি মানুষ দুর্নীতির শিকার হয়েছে বলে উঠে এসেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) প্রতিবেদনে।
সংস্থাটি জানিয়েছে, ২০২১ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীগুলোর কাছে সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হয় ৭৪ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী বলতে বোঝানো হয়েছে পুলিশ, র্যাব ও আনসারের মতো বাহিনীগুলোকে।
রাজধানীর ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে বুধবার সংস্থাটির কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় খানা জরিপ প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।
টিআইবির প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেবাদানে দুর্নীতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর পরই অবস্থান পাসপোর্ট অধিদপ্তরের। এ-সংক্রান্ত সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হন ৭০ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ।
এদিক থেকে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। গত বছর এ সংস্থাটির সেবা নিতে গিয়ে ৬৮ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ দুর্নীতির শিকার হন।
এর বাইরে বিচারিক সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতিতে পড়েছেন ৫৬ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ। এ ছাড়া ৪৮ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ স্বাস্থ্য খাতে সেবা পেতে দুর্নীতির শিকার হন।
১৭টি খাতের ওপর জরিপ চালায় টিআইবি। খাতগুলো হলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, পাসপোর্ট অধিদপ্তর, বিআরটিএ, বিচারিক সেবা, ভূমি সেবা, শিক্ষা (সরকারি ও এমপিওভুক্ত), স্বাস্থ্য (সরকারি), কৃষি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, বিমা, কর ও শুল্ক, ব্যাংকি, এনজিও (প্রধানত ক্ষুদ্র ও মাঝারি ঋণ) এবং অন্যান্য (জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ সহায়তা, মোবাইল ব্যাংকিং, অনলাইন শপিং, ওয়াসা, নির্বাচন কমিশন, ডাক বিভাগ, সমাজসেবা অধিদপ্তর ইত্যাদি)।
দেশের আটটি বিভাগকে গ্রামাঞ্চল ও শহরাঞ্চল বিবেচনায় ১৬টি স্তরে বিভাজন করে দৈবচয়নের মাধ্যমে ১ হাজার ৩২০টি মহল্লায় জরিপ চালানো হয়। এর মধ্যে গ্রামাঞ্চলে ৮২০ এবং শহরাঞ্চলে ৫০০টি গ্রাম বা মহল্লায় এ কাজ করা হয়। সেখান থেক ১০০ খানার তালিকা করে ১২টি খানা দৈবচয়নের মাধ্যমে নির্বাচন করা হয়।
১৫ হাজার ৪৪৫টি খানা জরিপে অংশ নেয়৷ মূলত একই পরিবারে বসবাসকারী একজনকে খানাপ্রধান হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী
গবেষণায় দেখা গেছে ৭৪ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে দুর্নীতির শিকার হন। পাশপাশি ৫৫ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ ঘুষের শিকার হন। এ খাতে খানাপ্রতি গড় ঘুষের পরিমাণ ৬ হাজার ৬৩৬ টাকা।
পাসপোর্ট অধিদপ্তর
৭০ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ জানান তারা তাদের পাসপোর্ট সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। অন্যদিকে এ সেবা পেতে ৫৫ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ ঘুষ দিয়েছেন। গড় ঘুষের পরমিাণ ৫ হাজার ৫৫৫ টাকা।
বিআরটিএ
৬৮ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ জানান তারা বিআরটিএ সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। অন্যদিকে এ সেবা পেতে ৫০ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ ঘুষ দিয়েছেন। এ খাতে গড় ঘুষের পরিমাণ ৫ হাজার ১৪৭ টাকা।
বিচারিক সেবা
গবেষণায় অংশ নেয়া ৫৬ দশমিক ৮ শতাংশ নাগরিক জানান তারা বিচারিক সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। অন্যদিকে এ সেবা পেতে ২৩ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ ঘুষ দিয়েছেন। এ খাতে গড় ঘুষের পরিমাণ ১৯ হাজার ৯৬ টাকা।
স্বাস্থ্য (সরকারি)
গবেষণায় অংশ নেয়া ৪৮ দশমিক ৭ শতাংশ নাগরিক জানান তারা সরকারি হাসপাতালে সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। অন্যদিকে এ সেবা পেতে ৬ দশমিক ২ শতাংশ মানুষকে ঘুষ দিতে হয়েছে। এ খাতে গড় ঘুষ ৬৮০ টাকা।
স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান
গবেষণায় অংশ নেয়া ৪৬ দশমিক ৬ শতাংশ নাগরিক জানান তারা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। অন্যদিকে এ সেবা পেতে ৩৩ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ ঘুষ দিয়েছেন, এ খাতে গড় ঘুষের পরিমাণ ১ হাজার ১২ টাকা।
ভূমি সেবা
৪৬ দশমিক ৩ শতাংশ নাগরিক জানান তারা ভূমি সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। অন্যদিকে এ সেবা পেতে ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষকে ঘুষ দিতে হয়েছে। যেখানে গড় ঘুষের পরিমাণ ৭ হাজার ২৭১ টাকা।
শিক্ষা (সরকারি ও এমপিওভুক্ত)
গবেষণায় অংশ নেয়া ৩৩ দশমিক ৯ শতাংশ নাগরিক জানান তারা শিক্ষা সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। অন্যদিকে এ সেবা পেতে ১৬ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ ঘুষ দিয়েছেন। এ খাতে গড় ঘুষের পরিমাণ ৭০২ টাকা
বিদ্যুৎ
৩৩ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। অন্যদিকে এ সেবা পেতে ৭ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ ঘুষ দিয়েছেন। এ খাতে গড় ঘুষের পরিমাণ ৩ হাজার ২৮৬ টাকা।
জলবায়ু পরিবর্তন
২৭ দশমিক ৮ শতাংশ নাগরিক জানান তারা জলবায়ু পরিবর্তন সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। অন্যদিকে এ সেবা পেতে ২ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ ঘুষ দিয়েছেন, যা গড় ঘুষের পরিমাণ ১ হাজার ৩৬৫ টাকা।
কৃষি
২৪ দশমিক ৫ শতাংশ কৃষি সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হয়েছেন বলে জানান। এদের মধ্যে সেবা পেতে ৪ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ ঘুষ দিয়েছেন। যার গড় পরিমাণ ২৬৬ টাকা।
এ ছাড়া বিমা, ব্যাংকিং, গ্যাস, মোবাইল ব্যাংকিং, অনলাইন শপিং, ওয়াসা, নির্বাচন কমিশন, ডাক বিভাগ, সমাজসেবা অধিদপ্তর ইত্যাদি খাতেও মানুষ দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। আর এসব সেবা নিতে গিয়েও ঘুষ দিতে হয়েছে।
শহরের মানুষের চেয়ে গ্রামের মানুষ দুর্নীতির শিকার বেশি
টিআইবির গবেষণায় উঠে এসে সেবাখাতে সার্বিকভাবে ৭০ দশমিক ৯ শতাংশ খানা সেবাখাতে দুর্নীতির শিকার হন। যারমধ্যে গ্রামের মানুষ দুর্নীতির শিকার বেশি হন। গ্রামের ৭১ দশমিক ২ শতাংশ সাগরিক সেবাখাতে দুর্নীতির শিকার হন, পাশাপাশি শহরের ৭০ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ এ পরিস্থিতির সম্মুখীন হন।
অন্যদিকে গণেষণায় দেখা গেছে, সার্বিকভাবে ৪০ দশমিক ১ শতাংশ নাগরিক সেবাখাতে ঘুষের শিকার হন। তবে গ্রামের ৪৬ দশমিক ৫ শতাংশ নাগরিকরা এ ঘটনার সম্মুখীন হন। শহরে এর পরিমাণ কম। শহরের ৩৬ দশমিক ৬ শতাংশ নাগরিকরা সেবা পেতে ঘুষের ব্যবহার করেন। তবে গ্রামের প্রতিটি খানায় গড় ঘুষের পরিমাণ ৪ হাজার ৫৫৫ টাকা।
অন্যদিকে শহরে খানাপ্রতি এ পরিমাণ ৮ হাজার ৫০ টাকা। শহর গ্রাম মিলিয়ে খানাপ্রতি গড় ঘুষের পরিমাণ ৬ হাজার ৬৩৬ টাকা।
পুরুষের চেয়ে নারীরা দুর্নীতির শিকার বেশি হন
গবেষণায় দেখা যায়, লিঙ্গভেদে পুরুষের চেয়ে নারীরা দুর্নীতির শিকার বেশি হন। তবে তারতম্যের পরিমাণ খুব একটা বেশি না। ৭২ দশমিক ৪ শতাংশ নারীরা দুর্নীতির শিকার হলেও পুরুষের ক্ষেত্রে সে পরিমাণ ৭০ দশমিক ৭ শতাংশ।
নারীদের চেয়ে ঘুষ বেশি দেয় পুরুষ
সেবাখাতে সেবা পেতে নারীদের চেয়ে পুরুষরা বেশি ঘুষ দিয়ে থাকে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। সেবা পেতে ৪০ দশমিক ২ শতাংশ পুরুষেরা ঘুষের আশ্রয় নিয়ে থাকে। তবে নারীদের ক্ষেত্রে সে পরিমাণ ৩৯ দশমিক ৪ শতাংশ।
গবেষণায় অংশ নেয়া ৭২ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ মনে করেন, ঘুষ ছাড়া সেবা পাওয়া যায় না। ২০২১ সালে জাতীয় পর্যায়ে প্রাক্কলিত ঘুষের পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা। যা জাতীয় সংশোধিত বাজেটের ৫ দশমিক ৯ শতাংশ। বাংলাদেশের জিডিপির শূন্য দশমিক শতাংশ।