শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পর বাংলাদেশের পরিস্থিতিও এমন হবে বলে বিএনপি নেতারা ক্রমাগত যে বক্তব্য দিয়ে আসছেন, তার জবাব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেছেন, বিএনপির শাসনামলে বাংলাদেশের অবস্থা শ্রীলঙ্কার মতো হলেও সেখান থেকে তার সরকার বাংলাদেশকে টেনে তুলেছে।
বিদেশি ঋণ পরিশোধে শ্রীলঙ্কা ব্যর্থ হলেও বাংলাদেশের এমন কোনো শঙ্কা নেই বলেও জানান সরকারপ্রধান। বলেছেন, ‘ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা বাংলাদেশের আছে, তাই বাংলাদেশ কোনোদিন শ্রীলঙ্কা হবে না।’
জাতীয় শোক দিবস স্মরণে মঙ্গলবার ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগের আলোচনায় প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দিয়ে তিনি এসব কথা বলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘এটুকু বলি, আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযোগ দিয়ে লাভ নেই। আজকে আন্দোলন, কেউ শ্রীলঙ্কা বানাচ্ছে বাংলাদেশকে। আমরা আপনাদেরকে একটা কথা জানাতে চাই। যেহেতু আপনারা নেতা-কর্মী আপনাদের অনেক জায়গায় কথা শুনতে হয়, জবাবও দিতে হয়। একটা কথা মনে রাখবেন, বাংলাদেশ কোনোদিন শ্রীলঙ্কা হবে না, হতে পারে না।’
২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপির শাসনামলে দেশের পরিস্থিতি কেমন ছিল, সেটিরও স্মরণ করান প্রধানমন্ত্রী। বলেন, ‘বাংলাদেশ তো শ্রীলঙ্কার যে পরিস্থিতি, সেই পরিস্থিতি তো বিএনপির আমলে হয়েই গেছে। ২০০১-২০০৬-এ বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল পাঁচবার দেশ দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বিদ্যুতের জন্য হাহাকার, পানির জন্য হাহাকার, মানুষের কর্মসংস্থান নেই, তার ওপর জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, গ্রেনেড হামলা…তখনই তো মানুষ রাস্তায় নামল। তখনই মানুষ রাস্তায় নামতে বাধ্য হলো।
‘কাজেই শ্রীলঙ্কা তো…ওটা দেখেই তো বাংলাদেশকে ওখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছি। আজকে বাংলাদেশ কেন শ্রীলঙ্কা হবে? আমাদের যে অর্থনৈতিক গতিশীলতা, সেটা যেন অব্যাহত থাকে, অর্থনৈতিকভাবে আমাদের দেশটা যাতে এগিয়ে যেতে পারে, সে জন্য আমরা অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে কাজ করি।’
ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা। দুই কোটি জনসংখ্যার দেশটির অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ার পর তাদের বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধই শুধু অনিশ্চয়তায় পড়েনি, নাগরিকদের সুযোগ-সুবিধাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক সংকট।
- আরও পড়ুন: শ্রীলঙ্কার ভুলের একটিও নেই বাংলাদেশের
জনবিক্ষোভের মধ্যে দেশটির প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করে গেছেন অজ্ঞাত স্থানে, রাষ্ট্রপতি দেশ ছেড়ে হয়েছেন পরবাসী। নতুন সরকার দায়িত্ব নিয়ে পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের চেষ্টা করছে। তবে সহসা তাদের সংকট কাটছে না এটি স্পষ্ট।
পর্যটননির্ভর শ্রীলঙ্কান সরকারের রাজস্ব আয়ের খাত পর্যটনে ধস নেমেছে করোনার দুই বছরে। পর্যটকদের ভ্রমণ বন্ধ থাকায় কার্যত এ খাত থেকে দেশটির আয় হয়নি। কিন্তু পর্যটক আকৃষ্ট করতে গ্রহণ করা নানা প্রকল্পে আগে নেয়া বিপুল বিদেশি ঋণের কিস্তি ঠিকই পরিশোধ করতে হচ্ছে। শিল্প উৎপাদনে ধস নেমেছে, রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সও পৌঁছেছে তলানিতে। পাশাপাশি কর ও ভ্যাট কমানো, কৃষিতে রাসায়নিকের ব্যবহার শূন্যতে নামিয়ে আনার কারণে উৎপাদনের ঘাটতি, সব মিলিয়ে কিছু ভুল পরিকল্পনা আর পদক্ষেপের কারণে এমন দশায় পৌঁছেছে দেশটি।
বাংলাদেশের পরিণতিও শ্রীলঙ্কার মতো হবে কি না, তা নিয়ে নানা লেখা ঘুরছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। বিএনপি নেতারাও বক্তৃতায় তুলে ধরছেন প্রসঙ্গটি। তারা দাবি করছেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতিও শ্রীলঙ্কার মতো হবে কিছুদিনের মধ্যেই। ওই দেশের মতোই আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা ছেড়ে পালাতে হবে।
- আরও পড়ুন: শ্রীলঙ্কার মতো হবে না বাংলাদেশ: এডিবি
আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইডিবি, আইএমএফের মূল্যায়ন অবশ্য ভিন্ন। তারা নানা প্রতিবেদন ও মূল্যায়ন তুলে ধরে বলেছে, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কিছুটা চাপে থাকলেও সংকটে নেই।
শ্রীলঙ্কার মতো ভুল বাংলাদেশ করেনি জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা কখনও ধার করে ঘি খাই না। আমাদের যে ডেবট (ঋণ) এটার এমন অবস্থা না যে কারও কাছে আমরা আটকা পড়ে যাব। বাংলাদেশ একটি দেশ, যেখান থেকে আমরা যে সমস্ত ঋণ নিচ্ছি সময়মতো তা পরিশোধ করে যাচ্ছি। বাংলাদেশের সেই রেকর্ড আছে। সেটা কিন্তু আমরা খুব সতর্কতার সঙ্গে করছি।’
সতর্কতার সঙ্গে পরিকল্পিতভাবে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলেই বাংলাদেশ বাধা-বিপত্তি এত কিছু পেরিয়ে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে বলে জানান শেখ হাসিনা।
ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে জ্বালানি, খাদ্য ও অর্থনীতি নিয়ে চাপের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী সবাইকে জ্বালানি সাশ্রয়ী হওয়ারও আহ্বান জানান। সেই সঙ্গে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর তাগিদ দেন।
তিনি বলেন, ‘সারা বিশ্বব্যাপী কিন্তু দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি। কিন্তু আমাদের যেহেতু মাটি আছে, মানুষ আছে, আমাদের মাটি উর্বর, এ জন্য আমি সবাইকে আহ্বান করেছি যার যতটুকু জমি আছে, যে যা পারেন নিজেরা উৎপাদন করেন। যাতে বিশ্বের খাদ্য মন্দাটা আমাদের ওপর এসে না পড়ে।
‘যেটা আমরা আমদানি করতে পারব না, তার বিকল্প দেশে উৎপাদন করে যেন আমরা আমাদের ক্ষুধা নিভৃত করতে পারি, সে জন্য আমাদের সবাইকে সজাগ থাকতে হবে।’