জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল বাচেলেট বাংলাদেশ সফরে আসার পর আবার আলোচনায় এসেছে গুম বা জোরপূর্বক অন্তর্ধান প্রসঙ্গ। বাংলাদেশ থেকে ফিরে মিশেল ব্যাচেলেট তার সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনে যেসব দেশের মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, সেগুলোর মধ্যে নেই বাংলাদেশ।
স্বাধীন মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পরিসংখ্যানও বলছে, গত কয়েক বছরে দেশে গুমের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমছে। তবে এ নিয়ে স্বস্তি প্রকাশের মতো পরিস্থিতি হয়নি বলে মনে করছেন অধিকার কর্মী ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
সরকার বরাবর বলে আসছে, যেসব ঘটনাকে গুম হিসেবে উল্লেখ করা হয়, তার অনেক ঘটনাই স্বেচ্ছা অন্তর্ধান, যাদের অনেকে ফিরেও এসেছেন।
দেশের মানবাধিকার বিষয়ে বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ২০২০ সালের ২৯ আগস্ট প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ২০০৭ থেকে ২০২০ সাল (২৫ আগস্ট) পর্যন্ত ৬০৪ জন গুমের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে ৭৯ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী গ্রেপ্তার দেখিয়েছে ৮৯ জনকে। ফেরত এসেছে ৫৭ জন। বাকিদের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য গণমাধ্যমে পাওয়া যায়নি।
দেশের শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদ ও নিজেদের সংগ্রহ করা তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদন তৈরি করে আসক। সেই প্রতিবেদন অনুসারে ২০১৬ সালে গুমের শিকার হয়েছিলেন ৯৭ জন, ২০১৭ সালে ৬০ জন, ২০১৮ সালে ৩৪, ২০১৯ সালে ১২, ২০২০ সালে ৬ জন ও ২০২১ সালে ৭ জন। আর ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত গুমের শিকার হয়েছেন ২ জন। এদের মধ্যে ২০১৯ সালে যে ১৩ জন গুমের শিকার হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে ৪ জন ফিরে এসেছেন, একজনকে গ্রেপ্তার দেখিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী এবং নিখোঁজ আছেন ৮ জন।
২০২০ সালে যে ৬ জন গুমের শিকার হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে ৪ জনকে গ্রেপ্তার দেখিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী, দুজন এখনও নিখোঁজ। ২০২১ সালে যে ৭ জন গুমের শিকার হয়েছেন, তাদের ৬ জনকে পরবর্তী সময়ে গ্রেপ্তার দেখিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। একজন এখনও নিখোঁজ। আর চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত যে দুজন গুমের শিকার হয়েছেন, তাদের একজনকে আটক অবস্থা থেকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে, গ্রেপ্তার হয়েছেন অন্যজন।
তবে এ পরিসংখ্যান দেখে গুম কমে গেছে বলার সময় এখনও আসেনি বলে মনে করেন মানবাধিকারকর্মী ও আসকের নির্বাহী পরিচালক মো. নূর খান লিটন। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এখন পরিসংখ্যান যেটা দেখছেন তা প্রকৃত পরিসংখ্যান নাও হতে পারে। কারণ অনেক বিষয় কাজ করে। এখন ক্রমান্বয়ে তথ্যের প্রকাশ কম হচ্ছে। আমরা ফিল্ড লেভেলে কাজ করতে গিয়ে তা দেখছি। কুষ্টিয়ায় সাম্প্রতিক সময়ে দুই দিনের জন্য গুম হয়েছে পাঁচজন। পরে দেখা গেল, র্যাব হাজির করল। দুই দিন আটক রাখা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কিন্তু তারা করল।
‘এটা (গুম) যে একেবারে কমে গেছে, তা বলার সুযোগ নেই। তবে হ্যাঁ, গত ডিসেম্বরের ১০ তারিখে স্যাংশন (ভিসা-সংক্রান্ত বিধিনিষেধ) দেয়ার পর আমরা লক্ষ্য করছি সংখ্যাটা কমে এসেছে। এটা দিয়ে এখনই চূড়ান্তভাবে বলার সুযোগ আসেনি যে গুম কমে গেছে বা বন্ধ হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘গত ১০ বছরের রিপোর্টে আমরা দেখতে পাই, অনেক সময় গুম বেড়েছে, ক্রসফায়ার কমেছে। আবার ক্রসফায়ার বেড়েছে, গুম কমেছে। এ রকম একটা গ্রাফ দেখা যায়। মেজর সিনহা হত্যার পর বেশ কয়েক মাস ক্রসফায়ার বা গুমের ঘটনা এক-দুইটার বেশি হয় নাই। পরবর্তী সময়ে যে মাত্রায় ঘটে, তাই ঘটছে।’
গুম বা বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ করতে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে বলে মনে করেন এই মানবাধিকারকর্মী। তিনি বলেন, ‘যারা নীতিনির্ধারক, তাদের অজ্ঞাতসারে কিছু হওয়ার সুযোগ নেই। তাদের অজ্ঞাতসারে দিনের পর দিন গুম-খুন চলার কোনো সুযোগ নেই। তার মানে হচ্ছে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে এটা কমবে। না হলে কমবে না।’
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট বাংলাদেশ সফরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ৭৬ জন গুমের বিষয়ে একটি তালিকা দিয়ে তথ্য চেয়েছিলেন। এ ছাড়া আরও কিছু প্রশ্ন দিয়েছিলেন তিনি, যেগুলো নিয়ে তিনি সরকারের সংশ্লিষ্টজনদের সঙ্গে কথা বলেছেন।
গত ১৪ আগস্ট সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দপ্তরে গুম ও অন্যান্য পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠক করেন মিশেল ব্যাচেলেট। বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘আমাদের ৭৬ জনের মিসিং বা ডিস-অ্যাপিয়ার্ড পারসনের তালিকা দেয়া হয়েছিল। আমরা দেখিয়ে দিয়েছি এ ৭৬ জনের মধ্যে ১০ জন তাদের বাড়িতেই আছেন। দুজন আছেন জেলখানায়।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা তাকে বলেছি, আমাদের দেশে তিনটি কারণে ডিস-অ্যাপিয়ার হয়: প্রথম কারণ হচ্ছে ঘৃণ্য অপরাধ যারা করে, ভিডিওর মাধ্যমে আমরা দেখিয়েছি, পুলিশকে পিটিয়েও তারা হত্যা করেছে। আমরা এটাও দেখিয়েছি, কীভাবে তারা মানুষের সম্পদ ধ্বংস করেছে। যারা এগুলো করেছে, তারা সীমান্তের ফাঁকফোকর দিয়ে বিভিন্ন দেশে চলে গেছে। তারা ভারত কিংবা মিয়ানমার কিংবা অন্য কোনো জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে। বাকিগুলো সব আমাদের সঙ্গেই আছে।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘যেহেতু বিচার বিভাগ স্বাধীন, কাজেই বিচার কাজকে এড়ানোর জন্যই তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। সেগুলোর নমুনা আমরা তাদের দিয়েছি, আসলে তারা কী ধরনের ক্রাইম করেছে। আর একটি বিষয় আমরা তাদের বলেছি, যারা দেউলিয়া হয়ে যায়, পাওনাদার বেড়ে যায়, ফলে পাওনাদারদের এড়ানোর জন্য গায়েব হয়ে যায়, আত্মগোপনে যায়। আমরা যখন অভিযোগ পাই, তখন আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের খুঁজে বের করে আনলে এসব তথ্য বেরিয়ে আসে। আবার পারিবারিক কারণেও অনেকেই গুম হয়ে যায়।’
বছরের পর বছর অপেক্ষা
২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে র্যাব পরিচয়ে তুলে নেয়া হয় ঢাকা মহানগর ৩৮ (বর্তমান ২৫) নং ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম সুমনকে। সেদিন সুমনসহ আরও পাঁচজনকে সেখান থেকে তুলে নেয়া হয়। ৯ বছরেও তাদের সন্ধান মেলেনি।
র্যাব, পুলিশ, মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠন কোথাও যেতে বাদ দেননি সুমনের পরিবার। এমন গুমের শিকার পরিবারগুলো একত্রিত হয়েছে ‘মায়ের ডাক’ নামে ব্যানারে। এর সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করছেন সুমনের বোন আফরোজা ইসলাম আঁখি। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বছরের পর বছর অপেক্ষা করেও আমরা ক্লান্ত না। আশায় আছি, আমার ভাইকে ফিরিয়ে দেয়া হবে। আমার মা অসুস্থ, ভাইয়ের অপেক্ষায় দিন গুণছে। ভাইয়ের স্ত্রী সন্তানেরা অপেক্ষায় আছে।’
তিনি বলেন, "সম্প্রতি প্রকাশিত 'আয়নাঘর' নিউজ দেখে আমরা আরো বেশি আশাবাদি হয়েছি। আমরা দাবি জানাচ্ছি, আমাদের স্বজনদের ফিরিয়ে দেয়া হোক। আমার ভাই বিএনপির রাজনীতি করত, এই কারণেই গুম করা হয়েছে। তার তো আর কোনো অপরাধ ছিল না।"
মিশেল বাচেলেট বাংলাদেশে আসার পর ‘মায়ের ডাকে’র প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করেছেন, তাদের কথা শুনেছেন। আফরোজা ইসলাম আঁখি বলেন, ‘আমরা ব্যাচেলেটকে গুম হওয়া ৬১৯ জনের একটি তালিকা দিয়েছি। তিনি আমাদের কথা শুনেছেন।’
জাতীয় প্রেস ক্লাবে মায়ের ডাক আয়োজিত অনুষ্ঠানে নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনরা। ফাইল ছবি
সংখ্যাগত দিকে গুমের ঘটনা কমলেও স্বস্তিতে থাকার সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেছেন অধিকারকর্মী ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গুম পরিস্থিতি ইতিবাচক তখনই বলতাম যখন দেখতাম গুম হয়ে যাওযা পরিবারের সদস্যরা তাদের যে লোকটা হারিয়ে গেছে তাকে খুঁজে পেয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত হারিয়ে যাওয়া লোকদের খুঁজে পাওয়া না যায়, ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো অধিকার কর্মীর স্বস্তিতে থাকার কারণ নেই।’
নূর খান লিটন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এই (গুম) ধরনের ঘটনার সঙ্গে যারা যুক্ত, তাদের যতদিন পর্যন্ত বিচারের আওতায় না আনতে পারবেন ততদিন এইটা কমবে না। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে যতদিন রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করবেন, ততদিন এটা কমবে না। তারা যতদিন বলতে থাকবে, সরকার তো আমরাই আনি, ততদিন পর্যন্ত কমার সুযোগ নেই।’