ছাদ থেকে পড়ে মারা যাওয়া ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী সানজানা মোসাদ্দিকার মৃত্যুর পরই জানা গিয়েছিল বাবার হাতে তার নিয়মিত নির্যাতিত হওয়ার কথা। এই তরুণীর এক প্রতিবেশীর কাছ থেকে এবার জানা গেল মাসখানেক আগে সানজানা তার প্রাণ বাঁচাতে চিৎকার করার পর তারা গিয়ে দেখতে পান, তার গলায় বঁটি ধরে আছেন বাবা।
নিয়মিত মারধরের চাপ নিতে পারেননি সানজানা। তিনি মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন মা।
তার মৃত্যুর জন্য বাবা শাহীন ইসলামকে দায়ী করে তার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন সানজানার মা উম্মে সালমা।
রাজধানীর বিমানবন্দর মোড়ে হাজি ক্যাম্পের পাশে দক্ষিণখানের বটতলা এলাকার বাড়ি ধানসিঁড়ি ভিলার অষ্টম তলায় নিজেদের ফ্ল্যাটে থাকতেন সানজানা।
মেয়ে এবং তাকে নিয়মিত নির্যাতনের অভিযোগ এনে সালমা দুই মাস আগে শাহীনকে তালাক দিলেও তিনি জোর করেই বাসাতে থাকতেন বলে তথ্য মিলেছে। তবে ঘটনার রাত থেকেই তিনি পলাতক।
সানজানাদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকেন সুরাইয়া লতা। তার কাছেই জানা গেল সানজানাকে তার বাবার নিপীড়ন-নির্যাতনের কাহিনি।
রাজধানীর দক্ষিণখানের বটতলা এলাকার বাড়ি ধানসিঁড়ি ভিলার অষ্টম তলায় নিজেদের ফ্ল্যাটে থাকতেন সানজানা। ছবি: নিউজবাংলা
সেটি মাসখানেক আগের কথা। লতা বলেন, ‘ওই বাসা থেকে একজন নক করে বলেন আমাদের বাঁচান। গিয়ে দেখি সানজানার বাবা বঁটি হাতে মেয়েকে মারার জন্য উদ্যত হয়েছেন। আমরা সবাই যাওয়ায় আর মারেনি। তবে এমনভাবে সানজানার ঘাড়ে বঁটি ধরা ছিল যে আঘাত করলেই মারা যেতে পারত মেয়েটি।’
লতা জানান, সেদিন মেয়েটির জীবন বাঁচাতে দীর্ঘ সময় সেখানে অপেক্ষা করেছেন। তিনি বলেন, ‘তখন আমরা সেখানে দাঁড়িয়ে থাকি এই ভেবে যে বাইরের মানুষের সামনে হয়তো কিছু করবে না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পরে সেখান থেকে আসি।’
আরেক প্রতিবেশী নাজমুন নাহার বলেন, ‘তাদের (শাহীন ও সালমা) এসব ঝগড়াঝাঁটি অনেক আগে থেকেই চলে আসছে। আমি বলেছি, যার সঙ্গে হচ্ছে না, বাদ দেন। কিন্তু রোজ এসব মারামারি চারপাশের পরিবেশ নষ্ট করছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সানজানার বাবা আশপাশে প্রচার করেছেন, সে তার সন্তান না। তার স্ত্রীর আগের ঘরের সন্তানসহ তাকে বিয়ে করেছেন। তবে ঘটনা যাই হোক, জেনেশুনেই উনি সব করেছেন। এভাবে মারামারি তো করতে পারেন না।’
সানজানা মোসাদ্দিকার মৃত্যুর জন্য বাবা শাহীন ইসলামকে দায়ী করে তার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন সানজানার মা উম্মে সালমা। ছবি: নিউজবাংলা
মেয়েকে নিয়মিত মারতেন শাহীন
সানজানার ফ্ল্যাটে ঢুকতেই তার মা উম্মে সালমা জড়িয়ে ধরে শুরু করেন কান্না। মেয়েটির নানিও চোখের জল ধরে রাখতে পারছিলেন না।
সাংবাদিকদের দেখে বিলাপ করে সানজানার নানি বলছিলেন, ‘তোমরাই পারবা আসল বিচার আইন্যা দিতে। তোমরা তরুণ, তরুণরা ছাড়া কেউ পারবে না।’
পরিস্থিতি একটু শান্ত হতেই সালমা বলতে শুরু করেন সানজানার করুণ কাহিনির বয়ান।
তিনি বলেন, ‘আমাকে প্রায়ই প্রচুর মারধর করত তার বাবা। মেয়ে সব সময় প্রতিবাদ করত বলে তাকেও মারত। ঘটনার দিন সকালে তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে আমাকে মারতে এলে সানজানা প্রতিবাদ করে। তখন মেয়েকেও প্রচুর মারধর করে।’
‘মেয়েকে পড়াতে চাইতেন না বাবা। সেমিস্টারের টাকা চেয়েছে বলেও মারধর করেছে অনেক।’
সালমা জানান, মাস কয়েক আগে শাহীনের আরও একটি বিয়ে করার তথ্য জানতে পারেন তিনি। এটি সানজানাকে ভীষণ আহত করে।
তিনি বলেন, ‘সেই ঘরে তার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা। একদিকে বাবার অত্যাচার এবং দ্বিতীয় বিয়ের ঘটনায় সানজানা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে।’
কত দিন ধরে এমন অত্যাচার চলছে জানতে চাইলে সালমা বলেন, ‘সানজানার বাবা আগে ড্রাইভার ছিল। ৫ বছর ধরে অত্যাচারের মাত্রা বেড়েছে।
‘আমি অনেক ছোট থাকতে ১৪ বছর বয়সে তাকে পালিয়ে বিয়ে করি। আমার মা-বাবা শুরুতে রাজি না থাকলেও পরে এই বিয়ে মেনে নেন। শাহীনকে প্রতিষ্ঠিত করতে তাই বারবারই টাকা দিতেন তারা।’
সালমা জানান, তার বাবা-মা শাহীনকে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠিত করতে জমি বিক্রির ৫৭ লাখ টাকা দেন। কিন্তু মুফতে পাওয়া সেই টাকা তিনি উড়ান আর বিভিন্ন মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক করেন।
এমনকি বাসার কাজের মেয়ের সঙ্গে জোরপূর্বক শাহীনের শারীরিক সম্পর্কের বিষয়টি জানার পর সেই মেয়েটিকে বাড়ি পাঠিয়ে দেন সালমা। জানান, সানজানা নিজের চোখে দেখার পর বাবাকে ঘৃণা করতে শুরু করেন। পরে এ নিয়েও মেয়েকে মারধর করা হতো।
সানজানার ডায়েরি
সানজানা ডায়েরি লিখতেন। সেখানেও তার হতাশার কথা লেখা আছে। বেশি দিন বাঁচতে চান না, এই কথাটি নানাভাবে তুলে ধরেছেন তিনি।
জীবনে কিছু ভুলের জন্য অনুতপ্ত হওয়ার কথাও লেখা তার ডায়েরিতে। বাবার অত্যাচার, মানসিক অশান্তি থেকে কোনোভাবেই বের হতে না পারার কথাও উল্লেখ আছে।
সানজানার মা বলেন, ‘ছোট থেকেই নিজের বাবার প্রতি ঘৃণা নিয়ে বড় হয়েছে মেয়েটা। তাই সে ছেলেদের সহ্য করতে পারত না। বিয়ের কথা বললে রেগে যেত। ওর এক মেয়েবন্ধু সব সময় তাকে সাপোর্ট দিত, তাই সে তার খুব প্রিয় ছিল।’
আত্মহত্যার দিন সকালে সেই মেয়েবন্ধুর সঙ্গে সানজানা হোয়াটসঅ্যাপে যে চ্যাটিং করেন, সেখানেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার ইঙ্গিত ছিল বলে জানান সালমা।
সেই মেয়েটি সেদিনও তাকে সহায়তা করার চেষ্টা করেন। তিনি বারবার জিজ্ঞেস করেন, ‘এগুলো কী করছ?’, ‘আমি কি আসব?’, ‘তুমি, আন্টি ঠিক আছ?, ‘আংকেল কি গেছে?’- এ রকম আরও কিছু কথা।
অত্যাচারে দেখা দেয় মানসিক রোগ
সানজানার মা জানান, বাবার অত্যাচার ও নানা আপত্তিকর কর্মকাণ্ড দেখে সানজানা মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে যান। ডিপ্রেশনের কারণে তাকে ডাক্তারও দেখাতে হয়েছে।
প্রেসক্রিপশনে স্পষ্ট লেখা আছে সানজানার আত্মহত্যার প্রবণতা রয়েছে। তাকে নজরদারিতে রাখতে বলা হয়। পরে অন্য একজন চিকিৎসককে দেখালে তিনিও একই মত দেন। এই বিষয়টি জানার পরও শাহীন নিজেকে পাল্টাননি। সানজানাকে মারধর করেই গেছেন।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এইচ এম মাহমুদ হারুন নিউজবাংলাকে বলেন, 'এই ধরনের রোগীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা থাকে। তবে পরিবেশের নেতিবাচক প্রভাবের কারণে তা আরও তীব্র হয়। পারিবারিক অশান্তি তার একটি বড় কারণ।
প্রেসক্রিপশনে স্পষ্ট লেখা আছে সানজানার আত্মহত্যার প্রবণতা রয়েছে। তাকে নজরদারিতে রাখতে বলা হয়। ছবি: নিউজবাংলা
‘যেহেতু সানজানার পারিবারিক তীব্র অশান্তি ছিল এবং বাবাই তাকে শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচার করত, তাই তার এই আত্মহত্যার প্রবণতা আরও প্রকট হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘পারিবারিক অশান্তি যেকোনো ছেলেমেয়েকে ডিপ্রেশনের দিকে ঠেলে দেয়, যা চূড়ান্ত রূপ হতে পারে আত্মহত্যা।’
চিরকুট রহস্য
সানজানার মৃত্যুর পর একটি চিরকুট পাওয়া গেছে। তার মা বলছেন, এটি মেয়ে লিখে রেখে গেছে।
চিরকুটটি সানজানারই কি না, সেটি যাচাই করার কথা জানিয়েছে পুলিশ।
চিরকুটে লেখা ছিল, ‘আমার মৃত্যুর জন্য আমার বাবা দায়ী। একটা ঘরে পশুর সাথে থাকা যায়। কিন্তু অমানুষের সাথে না। একজন অত্যাচারী ও রেপিস্ট যে কাজের মেয়েকেও ছাড়ে নাই। আমি তার করুণ ভাগ্যের সূচনা।’
সানজানার মা বলেন, 'চিরকুটটা হাসপাতালে আমাদের বাসার নিরাপত্তারক্ষী দিয়েছে। এটি কোথায় ছিল জানি না। তবে শুনেছি সানজানার পাশেই পড়ে ছিল।’
চিরকুটে লেখা ছিল, ‘আমার মৃত্যুর জন্য আমার বাবা দায়ী। একটা ঘরে পশুর সাথে থাকা যায়। কিন্তু অমানুষের সাথে না। একজন অত্যাচারী ও রেপিস্ট যে কাজের মেয়েকেও ছাড়ে নাই। আমি তার করুণ ভাগ্যের সূচনা।’ ছবি: নিউজবাংলা
তবে নিরাপত্তারক্ষী জলিল শেখ বলেন, ‘চিরকুটের ব্যাপারে কিছু জানি না। আমার কাছ থেকে সানজানা দুপুর ১২টার দিকে চাবি নিয়ে যান। সাড়ে ১২টার দিকে ছাদ থেকে পড়ে যান।
‘পড়ার সময় নারকেলগাছের সঙ্গে বাধা পেয়ে বালিতে পড়েন। তাই সেভাবে আহত না দেখালেও হাত-পা কাটা এবং ভেঙেছে বোঝা যায়। আমরা তাড়াতাড়ি করে গাড়িতে তুলে পাশেই উত্তরা একটা হাসপাতালে নিয়ে যাই। তখন সানজানা বলেছিল, ‘পা পিছলে পড়ে গেছি।’
দক্ষিণখান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আজিজুল হক বলেন, ‘আমরা একটা চিরকুট পেয়েছি। হাতের লেখা যাচাই না করে কিছু বলা যাচ্ছে না। ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পেলেও বোঝা যাবে। তবে পরিবার থেকে জানতে পেরেছি, সানজানা মানসিকভাবে অসুস্থ ছিল। তার চিকিৎসাও চলছিল।’
সানজানা মোসাদ্দিকার মৃত্যুর জন্য বাবা শাহীন ইসলামকে দায়ী করে তার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন সানজানার মা উম্মে সালমা। ছবি: নিউজবাংলা
শাহীন কোথায়?
সানজানার মৃত্যুর ঘটনায় রোববার তার বাবার বিরুদ্ধে মামলা হয় আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগ এনে। সালমার করা সেই মামলার আগেই শাহীন লাপাত্তা হয়ে যান।
সানজানার মায়ের ধারণা, ভারতে পালিয়েছেন শাহীন। এই ধারণা করার কারণ জানতে চাইলে সালমা বলেন, ‘তার ভিসা লাগানো আছে। কয়েক দিন ধরেই চেষ্টা করছিলেন সেই দেশে যাওয়ার।’
দক্ষিণখান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আজিজুল হক জানান, শাহীনের ভারত চলে যাওয়ার বিষয়ে তাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমাদের কয়েকটি টিম কাজ করছে। আশা রাখি, দ্রুত তাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে।’
ব্র্যাকের প্রতিবাদ
বেসরকারি ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ছাত্রী সানজানা মুসাদ্দিকাকে হত্যা করা হয়েছে অভিযোগ করে তার বাবাকে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা।
মহাখালীর ওয়্যারলেস গেট এলাকায় রোববার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে মানববন্ধনে এমন দাবি করেন সানজানার সহপাঠী ও বন্ধুরা।
সানজানাকে হত্যা করা হয়েছে অভিযোগ করে তার বাবাকে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা।সানজানা ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের ছাত্রী ছিলেন।