বিএনপির সঙ্গে জামায়াত আর জোটবদ্ধ নয় বলে দলটির আমির শফিকুর রহমান একটি ভার্চুয়াল আলোচনায় যে বক্তব্য রেখেছেন, তাকে তালাকের সঙ্গে তুলনা করেছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া।
তিনি বলেছেন, ‘বিএনপিরে তালাক দিয়া একজন গেছেগা।’
শফিকুর গত শনিবার কুমিল্লায় জামায়াতের একটি ইউনিটের সঙ্গে আলোচনায় যে বক্তব্য রাখেন, তা গণমাধ্যমে বড় খবর হয়ে আসে পরদিন। যদিও বিএনপি এবং জামায়াতের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো বিজ্ঞপ্তি এখনও আসেনি, তার পরেও রাজনীতিতে বিষয়টি তোলপাড় তুলেছে।
সোমবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক আলোচনায় বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন ক্ষমতাসীন দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্ষদের নেতা। জাতীয় শোক দিবস স্মরণে এই সভার আয়োজন করে ১৪ দলের শরিক গণআজাদী লীগ।
বিএনপির জোট থেকে জামায়াতের চলে যাওয়া প্রসঙ্গে মায়া বলেন, ‘আজকে কিন্তু বিএনপিরে তালাক দিয়া একজন গেছেগা। হেরা বলে আগেই আমরা তালাক দিয়ে দিছি। বুঝলেন তো কারা?’
তখন সভাস্থল থেকে শ্রোতারা চিৎকার করে ‘জামায়াত’ বললে মায়া বলেন, ‘হেগো নাম আমি মুখে আনতে চাই না।’
১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী আন্দোলনের একপর্যায়ে ১৯৯৯ সালে জোটবদ্ধ হয় জামায়াত ও বিএনপি। সঙ্গে ছিল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি এবং আজিজুল হকের ইসলামী ঐক্যজোট।
প্রথমে এরশাদ ও পরে আজিজুল হক জোট ছেড়ে দেন। তবে সমালোচনার মধ্যেও জামায়াতকে বিএনপি কখনও ছাড়তে রাজি হয়নি।
দুই বছর পর যে জাতীয় নির্বাচন হয়, তাতে এই জোটের ভূমিধস জয়ের পেছনে দুই দলের ভোট যোগ হওয়াই ছিল প্রধান কারণ।
তবে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আবার জামায়াত সঙ্গ বিএনপির জন্য নেতিবাচক হিসেবেই ধরা দেয়। ওই নির্বাচনের আগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি বড় হয়ে ওঠার পর বিএনপি-জামায়াত জোটের ভরাডুবি হয়। স্বাধীনতাবিরোধী দলটিকে সঙ্গী করে ভোটে নেমে দীর্ঘদিনের শক্তিশালী অবস্থানেও বড় ব্যবধানে হেরে যায় বিএনপি।
ওই নির্বাচনের পর বিএনপির পক্ষ থেকে ১০টি কমিটি গঠন করা হয় বিপর্যয়ের কারণ পর্যালোচনার জন্য। এর মধ্যে ৯টি কমিটিই জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধতাকে দায়ী করে, যা ছিল বিএনপির তৃণমূল নেতাদের অভিমত।
নির্বাচনের পর বিএনপির তরুণ নেতারাও প্রকাশ্যেই দলীয় চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার কাছে দাবি তোলেন।
তবে দশম সংসদ নির্বাচনের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবিতে এবং নির্বাচনের পর সরকার পতনের দাবিতে আন্দোলনে জামায়াতকে নিয়েই যোগ দেয় বিএনপি। আর ব্যাপক সহিংসতার পর বিএনপি নেতারা নানাভাবে জামায়াতকে দায় দেন।
ওই নির্বাচনের পর একটি বিদেশি গণমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে খালেদা জিয়া বলেন, জামায়াতের সঙ্গে তাদের জোট কৌশলগত। সময় এলেই তিনি জামায়াতকে ত্যাগ করবেন।
এসব ঘটনায় আবার জামায়াত মনঃক্ষুণ্ন হয় বিএনপির প্রতি। যদিও তাদের পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য আসেনি।
মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াত নেতাদের বিচারের সময় বিএনপির কাছ থেকে প্রত্যাশিত সহযোগিতাও পায়নি জামায়াত। এ নিয়েও খেদ আছে দলের নেতাদের মধ্যে।
বিএনপি চারদলীয় জোট সম্প্রসারণ করে পরে ২০-দলীয় জোট গড়েছে। পাশাপাশি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামে আরও একটি জোট তারা করে গত সংসদ নির্বাচনের আগে।
এর মধ্যে বিএনপির জামায়াত ছাড়ার প্রসঙ্গ নানা সময়ই এসেছে। দশম সংসদ নির্বাচনের পর দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, সময় এলে তারা জামায়াতকে ছেড়ে দেবেন।
এর মধ্যে ২০২১ সালের শুরুতে বিএনপি এই জোট ত্যাগের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নিয়েও পরে আর গণমাধ্যমকে কিছু জানায়নি।
জাতীয় নির্বাচনে সারা দেশে জামায়াতের পাঁচ শতাংশের আশপাশে ভোট আছে। আর আওয়ামী লীগকে মোকাবিলায় এই ভোটকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখে আসছিল বিএনপি।
মায়া কথা বলেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও। বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামে অপারেশন ক্র্যাক প্লাটুনের এই বীর যোদ্ধা বলেন, আমরা যখন মুক্তিযুদ্ধ করি, তখনই জিয়াউর রহমানরা কিন্তু স্বাধীনতার বিপক্ষে ভেতরে ভেতরে কাজ করতে ছিলেন। তারা পাকিস্তানের এজেন্ট হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে ঘাপটি মারা অবস্থায় ছিলেন।
‘জিয়াউর রহমানরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করে। এরপরে জাতির পিতাকে হত্যা করা হয়। এ হত্যার মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমান তার হাতকে রক্তে রঞ্জিত করেছেন। এরপরও যখন তারা দেখল তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে না, তখন তারা জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পরিকল্পনা করে। ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জেল হত্যার সঙ্গে সরাসরি জিয়াউর রহমান জড়িত।’
সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে ১৪ দলের সমন্বয়ক ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু বলেন, ‘শেখ হাসিনা ক্ষমতায় না থাকলে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার করা সম্ভব হতো না। আজকে তিনি ক্ষমতায় আছেন বলেই তাদের বিচার করা সম্ভব হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘তার (শেখ হাসিনা) ওপর ১৯ বার হামলা করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে যে কারণে হত্যা করা হয়েছে, ঠিক একই কারণে শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে।’