বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

এই ঘর দিয়ে মাসে দেখানো হয় ২৩০০ টাকা মজুরি!

  •    
  • ২৭ আগস্ট, ২০২২ ১২:৩৪

চা-শ্রমিকের বাড়তি মজুরি দেখাতে মালিকপক্ষ যেসব সুযোগ-সুবিধার কথা উল্লেখ করে, তার মধ্যে আবাসন সুবিধা দেখানো হয়েছে দিনে ৭৬ টাকা ৯২ পয়সা। অর্থাৎ মাসে ২ হাজার ৩০০ টাকা, তবে যেসব ঘর দেয়া হয়, তাতে কেউ টাকা দিয়ে থাকতে চাইবেন কি? সিলেটে সরকারি লাক্কাতুরা বাগানে শ্রমিকদের দুটি ঘরের একটি মাটির তৈরি, ওপরে পুরোনো টিনের ছাউনি। অন্য একটি ভাঙা টিন দিয়ে তৈরি। কোন ঘরটির অবস্থা বেশি খারাপ, এ নিয়ে তর্কে বসলে সিদ্ধান্তে আসা কঠিন হয়ে যাবে।

চা-শ্রমিকদের মজুরি বেশি দেখাতে বাগান মালিকরা যে আবাসন সুবিধার কথা বলেন, সেটি একেবারেই মানহীন।

শ্রমিকদের কাছ থেকে জানা গেল, ঘরের সঙ্গে নেই রান্নাঘর বা টয়লেট সুবিধা। বৃষ্টির দিন ফুটা চাল দিয়ে পানি পড়ে। সেগুলোও মেরামত করে দেয় না মালিকপক্ষ। নিজেদের পয়সায় তা মেরামত করতে হয়।

বলাই বাহুল্য বেশিরভাগ শ্রমিকেরই মেরামতে বাড়তি খরচের সংগতি নেই। তাই ভঙ্গুর ঘরেই থাকতে হয়।

আবার কোথাও কোথাও একটি ঘর বরাদ্দ দেয়া হয়েছে বেশ কয়েকজন শ্রমিককে। কারও সন্তান বিয়ে করলে নতুন ঘর দেবে, এমনও নয়।

অথচ সুবিধার কথা বলে দিনে প্রায় ৭৭ টাকা মজুরি দেখানো হয়। এই হিসেবে মাসে মজুরি হয় ২ হাজার ৩০০ টাকার মতো, তবে যে ধরনের ঘর তাদের দেয়া হয়, গ্রাম এলাকায় তার ভাড়া ৭০০ থেকে আট শর বেশি নয়।

আবার মাটির একটি ঘর তৈরিতে খরচ বড়জোর ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। এই হিসাবে মাসে যে মজুরি দেখানো হয়, সেটি উঠে যায় চার থেকে পাঁচ মাসেই। হাতে গোনা যে দুই-একটি ইটের ঘর আছে, সেগুলোর মেরামত ব্যয়ও ৫০ থেকে ৬০ হাজারের বেশি নয়।

অবশ্য আইন অনুযায়ী আবাসন বা অন্য কোনো সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়, সেটি মজুরির অন্তর্ভুক্ত হবে না। তারপরও দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করতে সিলেট অঞ্চলের চা-শ্রমিকরা যখন আন্দোলনে নেমেছে, তখন বাগান মালিকদের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে একেকজন শ্রমিককে দিনে সব সুযোগ-সুবিধাসহ ৪০২ টাকা মজুরি দেয়া হয়।

এই বাড়তি মজুরি দেখাতে যেসব সুযোগ-সুবিধার কথা তারা উল্লেখ করে, তার মধ্যে আবাসন সুবিধা দেখানো হয়েছে দিনে ৭৬ টাকা ৯২ পয়সা।

এর বাইরে শ্রমিকরা তাদের বাসা বাড়িতে যে ফলমূল উৎপাদন করে, তার মূল্য বাবদ ১৪ টাকা, শ্রমিক কল্যাণ কর্মসূচি বাবদ ৪৩ টাকা, ধান ক্ষেতের জন্য ভুমি উন্নয়ন কর ০.১০ টাকাও ধরা হয়েছে।

শ্রমিকরা আসলে কী ধরনের আবাসন সুবিধা পায়, সেটি খতিয়ে দেখতে সিলেট ও হবিগঞ্জের বেশ কিছু বাগানের তথ্য নিয়েছে নিউজবাংলা।

সিলেটে সরকারি লাক্কাতুরা বাগানে শ্রমিকদের দুটি ঘরের একটি মাটির তৈরি, ওপরে পুরোনো টিনের ছাউনি। অন্য একটি ভাঙা টিন দিয়ে তৈরি।

কোন ঘরটির অবস্থা বেশি খারাপ, এ নিয়ে তর্কে বসলে সিদ্ধান্তে আসা কঠিন হয়ে যাবে। মাটির ঘরটির টিনের ছাউনি ফুটা হয়ে যাওয়ায় চালের ওপর ত্রিপল টাঙানো হয়েছে। দেয়ালও খসে খসে পড়ে যাচ্ছে। মেঝের অবস্থাও তথৈবচ।

অপর ঘরটিতে একটিও আস্ত টিন ব্যবহার করা হয়েছে কি না, সেটিও গভীর পর্যবেক্ষণের বিষয়। দেখলে মনে হয় পুরোনো টিনের অংশবিশেষ বা কুড়িয়ে পাওয়া টিন দিয়ে সেটি নির্মাণ করা হয়েছে। জোড়াতালি শতছিন্ন পোশাকের সঙ্গেই এর তুলনা মেলে।

হবিগঞ্জের চাঁন্দপুর, বেগমখান, সুরমা, দেওয়ন্দি ও আমুসহ বেশ কয়েকটি চা বাগান ঘুরেও একই চিত্র দেখা যায়।

বেগমখান ও চাঁন্দপুর বাগানে কয়েকটি আধা পাকা ঘর চোখে পড়েছে। কিছু ঘর টিনের, কিছু মাটির।

মাটির দেয়াল আর টিনের ছাউনির ২০ ফুট বাই ২০ ফুট একটি ঘরে ঠাঁই হয়েছে সুমি বাগতির পরিবারের।

কত বছর আগে সেটি বানিয়ে দেয়া হয়, সেটি মনে করতে পারেননি সুমি।

৬০ বছর বয়সী সুমি কেবল বলতে পারলেন, বিয়ের পর যখন বাগানে কাজ নেন, তখনই এটি বানিয়ে দেয় মালিক।

ঘরের ওপর যে টিন রয়েছে, সেটি অবশ্য বাগান মালিক করে দেননি। ছন দিয়ে কোনো রকমে মাথা গোঁজার একটি ঠাঁই করে দেয়া হয়।

সুমি বলেন, ‘ছন নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর নিজেরাই টিন লাগাইছি। এখন টিনও নষ্ট হইয়া গেছে। মেঘ আইলে ঘরে পানি পড়ে।’

অন্যদের ঘরও একই ধরনের জরাজীর্ণ। নষ্ট হলে মালিকপক্ষের সেটি মেরামত করে দেয়ার কথা থাকলেও তারা দেয় না।

চাঁন্দপুর চা বাগানের পঞ্চায়েত প্রধান সাধন সাঁওতালের কাছ থেকে জানা গেল আরেক তথ্য। তিনি জানান, শ্রমিকদের বেশিরভাগের ঘরই নিজেদের করা।

তিনি বলেন, ‘আমাদের বাগানের হাতেগোনা কয়েকজন বাগানের দেয়া ঘরে থাকেন। বাকিরা নিজেদের তৈরি করা ঘরে থাকেন।

‘বাগানমালিক যে বলে আমাদের ঘর বাবদ দিনে ৭৬ টাকা কাটা হয়, তাহলে আমাদের প্রশ্ন কেন কাটা হয়? আর যারা বাগানের ঘরে থাকে তাদের ঘরের অবস্থাও খুব খারাপ। ভাড়া যেহেতু কাটা হয়, তাহলে মালিকপক্ষ থেকে ঘর মেরামত করে দেয়ার কথা, কিন্তু শ্রমিকরা নিজেরাই সেগুলো বছরের পর বছর ধরে মেরামত করে আসছে।’

এই পঞ্চায়েতপ্রধান এও জানান, এক ঘরে একাধিক শ্রমিকও রয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘তাহলে ভাড়া তো একজনের কাছ থেকে কাটবে। দুইজন শ্রমিক থাকলে কেন দুইজনের কাছ থেকেই কাটা হয়?

‘এ ছাড়া অনিয়মিত শ্রমিকদের তো কোনো ঘর দেয়া হয় না। তাহলে তাদের মজুরিও কেন সমান?’

চা-শ্রমিক নারী সংগঠনের সভাপতি সন্ধ্যা রাণী ভৌমিক বলেন, ‘শ্রমিকদের যে ঘর বানিয়ে দেয়, তাতে কত টাকা খরচ হয়? মাটির ঘরগুলো ১২ হাজার আর ইটের ঘর ৫০/৬০ টাকার বেশি হওয়ার কথা না। অথচ আমাদের কাছ থেকে মাসে তেইশ শ টাকা কাটা হয়। আমরা বাইরে থাকলেও এই ঘরের ভাড়া ৭০০ থেকে ৮০০ হতো না।’

বেগমকান চা বাগানের শ্রমিক উদয় রাম বলেন, ‘আমাদের ছোট একটা ঘর দেয়া হয়। এই ঘরে চারজন মানুষও থাকা যায় না। ছেলে, মেয়ে, ছেলের বউ সবাইকে নিয়ে এক রুমে ঘুমাতে হয়। এর চেয়ে লজ্জা আর কী হতে পারে? এই ঘরে মুরগি পাললেও তাদের ভাড়া দিতে হয়। একটা টয়লেট বা রান্নাঘর দেয় না।’

ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত ওয়ার্ড সদস্য লক্ষ্মীরাম সাঁওতাল বলেন, ‘ঘরগুলো ভেঙে পড়ছে। বৃষ্টি হলে পানিতে ঘর ভিজে যায়। ঘরে থাকা যায় না। বাগানের পক্ষ থেকে এগুলো মেরামত করে দেয়ার কথা থাকলেও সেটা করে না। নিজেরাই মেরামত করছি ঘরের। তাহলে কেন এই ঘরের ভাড়া মাসের মাস কাটা হবে?’

সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এমাদ উল্লাহ শহীদুল ইসলাম শাহিন বলেন, ‘চা শ্রমিকদের ঘরগুলো খুবই জরাজীর্ণ। বেশিরভাগই ছাপড়া ঘরে থাকেন। এক কক্ষেই বাবা মা, ছেলে মেয়ে ও স্বামী-স্ত্রীকে থাকতে হয়।

‘ঘরের টিন ও বেড়া ভেঙে গেলেও মালিকপক্ষ তা মেরামত করে দেয় না। অথচ চা-বাগান ইজারার শর্তেই শ্রমিকদের আবাসনের ব্যবস্থা করার উল্লেখ আছে। শ্রম আইনেও এটা আছে।’

তিনি বলেন, ‘এসব ছাপড়া ঘরের জন্য মালিকপক্ষ যে ভাড়া দেখিয়েছেন, তাও অনায্য। শ্রমিকদের বাসস্থান দেয়ার শর্তেই তো তারা বাগান ইজারা নিয়েছেন। উল্টো শ্রমিকদের চাষের জায়গা দখল করে তারা রাবার বাগান করেন, মাছের খামার করেন। আর শ্রমিকরা একটা গাছ রোপণ করলেও তার রেশন কেটে নেয়া হয়।’

মাঠ পর্যায়ে দেখে আসা এই দুর্দশার সঙ্গে বাগান মালিকদের বয়ান মেলে না। মালিকদের সংগঠন চা-সংসদ, সিলেট ভ্যালির সভাপতি জি এম শিবলী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কিছু শ্রমিকের ঘর ভাঙা থাকলেও এখন বেশিরভাগ শ্রমিকেরই আবাসন অনেক ভালো। পাকা ঘরও দেয়া হচ্ছে। প্রতি বছর এসব মেরামতের জন্য টাকা দেয়া হয়।

‘কেবল ঘর নয়, ঘরের আশপাশেও অনেক জমি থাকে, যা তারা ব্যবহার করতে পারে। তারা চাষাবাদ করে, পশুপালন করে। সবকিছু মিলিয়েই একটা ন্যূনতম ঘর ভাড়া ধরা হয়েছে। এটা মোটেই বেশি কিছু নয়।’

মালিকদের দাবি আর সিলেটের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মজিবর রহমানের বক্তব্যে অবশ্য পার্থক্য আছে।

ডিসি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘চা শ্রমিকদের বাসস্থান খুবই নাজুক। অনেক ক্ষেত্রেই তারা পিছিয়ে আছেন। শ্রমিকদের ব্যাপারে সরকার খুব আন্তরিক।

‘সরকারের বিভিন্ন সেবার আওতায় তারা এসেছেন। মালিকপক্ষকেও এ ব্যাপারে আন্তরিক হতে হবে।’

এ বিভাগের আরো খবর