নানামুখী সংকটে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার। অর্থনৈতিক সংকট দৃশ্যমান। আছে রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক টানাপড়েন। দলের অভ্যন্তরীণ জটিলতার পাশাপাশি রাজপথে বিরোধী দলগুলো কর্মসূচি দিয়ে সক্রিয়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শরিক দলগুলোর পুরোপুরি আস্থা নেই।
নতুন করে বিরোধিতায় নেমেছে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। গুম-খুন নিয়ে দেশের ভেতরে ও বাইরে সরকারের সমালোচনা অনেক দিন ধরেই।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বাজার ব্যবস্থায় অস্থিরতা। এর মধ্যে কয়েকজন মন্ত্রীর নানা বিতর্কিত মন্তব্যে খোদ আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায় থেকে এসেছে বিরক্তি। সব মিলিয়ে এক ধরনের অস্বস্তির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ।
সাম্প্রতিক সময়ে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, লোডশেডিং, ইউরিয়া সার এবং জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ানোয় দেশে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। বিভিন্ন সংগঠন, প্রতিষ্ঠান এবং বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ জানানো শুরু হয়।
২৫ আগস্ট দেশ অনেক দিন পর নামমাত্র হলেও হরতালের সম্মুখীন হলো। জ্বালানি তেল, ইউরিয়া সার, নিত্যপণ্যের দাম ও পরিবহনের ভাড়া কমানো এবং বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া বন্ধের দাবিতে বাম গণতান্ত্রিক জোট আজ অর্ধদিবস হরতাল পালন করেছে। এর আগে প্রায় কাছাকাছি দাবিতে দেশব্যাপী বিক্ষোভ করে বিএনপি। এ ছাড়া বিভিন্ন সভা-সমাবেশ-মিছিল থেকে দলটির নেতাকর্মীরা সরকার পতনের আন্দোলনের ঘোষণাসহ নানা হুঁশিয়ারি এবং হুমকিও দিচ্ছেন।
ছয় দফা দিবসে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় আওয়ামী লীগ। ফাইল ছবি
গত ১০ আগস্ট জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে দেশব্যাপী বিক্ষোভ করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ।
এর আগে একই দাবিতে গত ৬ আগস্ট মানববন্ধন করে আরেক বড় শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি। প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ জানায় আরেক শরিক গণতন্ত্রী পার্টি।
তবে সরকারের পক্ষ থেকে এসব সংকটকে দৈনন্দিন স্বাভাবিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে শাসক দল আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরুল্লাহ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সবকিছুর দাম বেড়েছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেই দাম বাড়ার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এ বিষয়টি সাময়িক। বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম কমে আসলে সরকার দাম সমন্বয় করবে। তখন দ্রব্যমূল্য অনেকটাই কমে আসবে।’
আওয়ামী লীগের অন্যতম এ নীতিনির্ধারক দ্রব্যমূল্য কমার আশা প্রকাশ করলেও বাজার ব্যবস্থায় শুরু হয়েছে অস্থিরতা।
রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়। ফাইল ছবি
আজ মুরগির দাম বাড়ে তো কাল ডিমের দাম। ডিমের দাম নিয়ন্ত্রণে আসার আগেই শুরু হয়েছে চালের বাজারে অস্থিরতা। এ বিষয়টির প্রতি কাজী জাফরুল্লাহর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, ‘এক ধরনের অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট এবং কারসাজি করে দাম বাড়ানোর চেষ্টা করে। তবে এ সমস্যা সমাধানে ভ্রাম্যমাণ আদালতসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ কাজ করছে।’
বিরোধীদের রাজপথ দখল নিয়েও ঘোষণায় আওয়ামী লীগ শঙ্কিত নয় বলে দাবি করেছেন দলটির আরেক সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমান। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শোকের মাস আগস্টে আওয়ামী লীগ কোনো সাংগঠনিক কর্মসূচি পালন করে না। কিন্তু সেপ্টেম্বর থেকেই তাদের দল এবং জোট রাজপথে থাকবে।’
এ প্রসঙ্গে আব্দুর রহমান ১৪ দলের মুখপাত্র আমির হোসেন আমুর গত বুধবারের ঘোষণার কথা স্মরণ করিয়ে দেন। শরিকদের সরকারের বিরোধিতায় রাজপথে নামার বিষয়ে তার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রতিটি দলের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আছে। প্রতিটি ইস্যুতে কথা বলার অধিকার আছে। তারা তাদের মতামত প্রকাশ করেছে মাত্র।
জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি এবং গণতন্ত্রী পার্টির কর্মসূচির বিষয়ে গত ১১ আগস্ট এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য গুরুত্ব বহন করে।
তিনি সেদিন বলেন, ‘জোটের শরিকদের দলগতভাবে কর্মসূচি দেয়ার অধিকার আছে। তারা করতে চাইলে করবে। আমাদের জোট তো আমাদের ইলেকশন অ্যালায়েন্স, সেটা তো কৌশলগত জোট। সেখানে আদর্শের কোনো বিষয় নেই।’
মন্ত্রীদের যেসব বক্তব্যে তুমুল সমালোচনা
গত ১০ আগস্ট স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, ‘গ্রামগঞ্জের কোনো মানুষ না খেয়ে নেই। প্রত্যেক মানুষের গায়ে জামাকাপড় আছে। আমি মনে করি না, আমরা খুব খারাপ অবস্থায় আছি।’
একই দিন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় এখনও কেউ মারা যায়নি, মরবেও না।’
সিলেটে গত ১৩ আগস্ট বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের সুখের তুলনা করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হয়ে যাবে, একটি পক্ষ থেকে এমন প্যানিক ছড়ানো হচ্ছে। বাস্তবে এর কোনো ভিত্তি নেই। বৈশ্বিক মন্দায় অন্যান্য দেশের তুলনায় আমরা বেহেশতে আছি। তার এ বক্তব্যেও দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় ওঠে।
১৮ আগস্ট চট্টগ্রামে এক সভায় তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনার সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য ভারতবর্ষকে যা যা দরকার তা করার অনুরোধ করেছি।’
আর গত ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৭তম শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনা সভায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে যেন জাহান্নামে ভালো জায়গায় স্থান করে দেয়।’
এসব বক্তব্য নিয়ে দলের ভেতরে-বাইরে নানা গুঞ্জন ও সমালোচনা শুরু হয়। তখন মুখ খোলেন আওয়ামী লীগ নেতারা।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারকে উদ্দেশ করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, যে সরকার অন্য দেশের আনুকূল্যে ক্ষমতায় ঠিকে থাকে তাদের দেশ পরিচালনার কোনো অধিকার নেই। শনিবার রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ইউনিভার্সিটি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইউট্যাব) আয়োজিত মানববন্ধনে তিনি এ কথা বলেন। ফাইল ছবি
মন্ত্রীদের বক্তব্য পছন্দ নয় আ.লীগেরই
সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দায়িত্বশীল পদে থাকা ব্যক্তিদের কথাবার্তায় সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে তিনি বলেন, ‘এ কে আব্দুল মোমেন সরকারের মন্ত্রী, তাকে দলের পক্ষে কোনো দায়িত্ব দেয়া হয়নি। কাজেই তার বক্তব্য আওয়ামী লীগের বক্তব্য নয়।’
সভাপতিমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য আব্দুর রহমান বলেন, ‘পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন দলের কেউ নন।’
আর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ বলেন, ‘পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির কেউ নন। তাই তার বক্তব্য আওয়ামী লীগের বক্তব্য নয়।’
সক্রিয় নাগরিক সমাজও
সাম্প্রতিক সময়ে দেশে জাতিসংঘের এক কর্মকর্তার সফরকে ঘিরে সক্রিয় হয়ে ওঠেন সুশীল সমাজের কিছু প্রতিনিধি। তারা ঐ কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করে দেশের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন। তাদের একজন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য গণমাধ্যমেও সরকারের সমালোচনা করে বক্তব্য দেন।
এ ছাড়া বিএনপিও সেই কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করে গুম-খুনের অভিযোগ করে, এবং জাতিসংঘকে তদন্তের অনুরোধ করে।
এসব ঘটনা চলাকালে সরকারের পক্ষ থেকেও তীব্র প্রতিক্রিয়া জানানো হয়।
অতীতে বিএনপি-জামায়াত জোটের সংখ্যালঘু নির্যাতন, বঙ্গবন্ধু হত্যা ও বিচার বন্ধ করা, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনা তুলে ধরা হয়। শাসক দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘একটা দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তদন্তের এখতিয়ার জাতিসংঘের নেই।’
শেষ পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে সেই কর্মকর্তা কোনো বক্তব্য দেয়া বা মতামত প্রকাশ করা এড়িয়ে যান।
পুলিশ প্রশাসনের কয়েক দিন আগের একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী সমালোচনা শুরু হয়।
চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি সিলেট যাওয়ার পথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যানজটে পড়ায় সংশ্লিষ্ট থানার ওসিকে স্টান্ড রিলিজ করেন। এ বিষয়টি নিয়েও চারদিকে সমালোচনা শুরু হয়।
সামাজিক গণমাধ্যমে এ নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে থাকেন ব্যবহারকারীরা। পুলিশের ক্ষমতা অপব্যবহারের দৃষ্টান্ত রয়েছে রাজধানীতেও।
কারওয়ান বাজারের একটি শপিং মলের সামনের রাস্তা শপিং মলটিকে এবং ধানমন্ডিতে আরেকটি রাস্তা সংশ্লিষ্ট অফিসকে ইজারা দেয়ার অভিযোগ উঠেছে পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের বিরুদ্ধে।
চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, ক্ষমতার অপব্যবহার, কমপক্ষে দুজন সরকারি কর্মকর্তার নারী কেলেংকারির ঘটনায় প্রশাসনেও অস্থিরতা বিরাজ করছে বলে একাধিক গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে।