রাজধানীর হলিক্রস স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী পারপিতা ফাইহার বহুতল ভবন থেকে লাফ দেয়ার একটি ভিডিও সামাজিকমাধ্যমে ছড়ালেও এই কাণ্ডের নেপথ্যে কী, সেটি নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েই গেছে।
মঙ্গলবার ১৪ বছর বয়সী মেয়েটির অপমৃত্যুর পরই প্রশ্ন ওঠে, কী সেই ঘটনা যা তাকে ছাদ থেকে লাফ দিতে প্ররোচিত করেছে।
পুলিশ বলছে, এই ঘটনায় তাদের কাছে কোনো অভিযোগ আসেনি। কিশোরীর পরিবারটিও বাসায় নেই। ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ নিয়ে গ্রামের বাড়ি গেছে। পারপিতার স্কুল থেকেও কোনো অভিযোগ করা হয়নি।
এ ঘটনায় হলিক্রস স্কুলের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। স্কুলটির কর্তৃপক্ষ সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে চাইছে না। এমনকি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরকে (ডিআইএ) ভুল তথ্য দেয়ার অভিযোগ উঠেছে।
কোনো পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ না এলেও বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চালাচ্ছে ডিআইএ। তারা জানতে চাইছে স্কুলের এক শিক্ষক যে মেয়েটিকে নম্বর কম দিয়েছেন বলা হচ্ছে, সেই নম্বর কম দেয়া ইচ্ছাকৃত কি না।
পাশাপাশি তেজগাঁও থানাও বিষয়টি খতিয়ে দেখছে। এই অপমৃত্যুর পেছনে কারও প্ররোচনা আছে কি না, সেটি বের করাই এই তদন্তের উদ্দেশ্য।
বৃহস্পতিবার পারপিতার বাসা, হলিক্রস স্কুল ও তেজগাঁও থানায় গিয়ে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করেছে নিউজবাংলা। কথা বলেছে ডিআইএ কর্মকর্তার সঙ্গে, তবে হলিক্রস স্কুলের মুখে একেবারেই কুলুপ।
পুলিশ ও ডিআইএ বলছে, বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত চলছে।
পারপিতার সহপাঠীদের কাছ থেকে জানা যায়, সে পড়াশোনায় বেশ ভালো, তবে সম্প্রতি পরীক্ষায় খারাপ ফল করে। এই খারাপ ফল করার পেছনে একটি অভিযোগ প্রচার পেয়েছে। সেটি হলো স্কুলের এক শিক্ষক মেয়েটিকে প্রাইভেট পড়তে বলার পরও সে পড়েনি। এরপর সেই শিক্ষকের বিষয়েই খারাপ ফলাফল হয় পারপিতার।
মরদেহ নিয়ে গ্রামের বাড়িতে মা-বাবা
তেজগাঁও রেলওয়ে স্টেশনের কাছে ‘নন্দন রোকেয়া’ নামের ১২ তলা একটি ভবনে পারপিতার পরিবারের বসবাস। বাসাটিতে তারা কিছুদিন আগে ওঠে বলে জানিয়েছেন বাসার নিরাপত্তারক্ষী। বিস্তারিত তথ্য নিতে না পারলেও তিনি জানিয়েছেন, পরিবারটির গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী।
নন্দন রোকেয়ায় গিয়ে পরিবারটিকে না পাওয়ার পর বাড়ির নিরাপত্তারক্ষী বলেন, ‘তারা কেউ বাসায় নেই।’
কোথায় গেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেই দিনই লাশ নিয়া বাড়ি নোয়াখালী গেছে।’
পরিবারের কারও মোবাইল নম্বর আছে কি না জিজ্ঞাসা করা হলে নিরাপত্তারক্ষী বলেন, ‘না, কয়েক মাস আগে তারা ভাড়ায় আসছে। তেমন চিনি না কাউরে।’
কিছুই বলবে না স্কুল বা সেই শিক্ষক
পারপিতার স্কুল হলিক্রসে গিয়ে গেট বন্ধ পাওয়া যায়। প্রায় এক ঘণ্টা বাইরে অপেক্ষার পর অভ্যর্থনা কক্ষে যেতে দেয়া হয়। সেখানকার অফিস সহকারী সৌরভ হোসেনকে অনুরোধ করা হয় পারপিতার শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেয়ার।
তিনি অপেক্ষা করতে বললেন। পরে বলেন, ‘কোনো শিক্ষক তদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার আগে কথা বলবেন না।’
যেকোনো একজন নারী শিক্ষকের সঙ্গে দুই মিনিট কথা বলা যাবে কি না, এমন প্রশ্নের পর সৌরভ ফোনে শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে আবার বলেন, ‘কেউ কথা বলতে চান না এ ব্যাপারে।’
যে শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়ার জন্য চাপের কথা উঠেছে, সেই শিক্ষক আছেন কি না জানতে চাইলে সৌরভ অনেকক্ষণ চুপ করে থাকেন। এরপর বলেন, ‘সব শিক্ষকই ক্লাস নিচ্ছেন।’
পারপিতার মৃত্যুতে স্কুলটির কোনো কার্যক্রমেই ব্যাঘাত ঘটেনি। রিসেপশন থেকে দেখা যায়, গানের সঙ্গে পিটি ক্লাস চলছে মাঠে। জানা গেল ক্লাস চলেছে যথারীতি, এমনকি মেয়েটি যে ক্লাসে পড়ত, সেখানেও।
গেটেই দেখা হয় ওই স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া এক শিক্ষার্থীর মায়ের সঙ্গে। তিনি বলেন, “এই ঘটনা যেমন দুঃখজনক, তেমনি আমাদের কাছে আতঙ্কের। এর পর থেকে আমার মেয়ে এখনও ঠিকভাবে পড়তে বসে না। বলে, ‘আপুটা কেন এমন করল।’”
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা দেখে এবং শুনে আসছি, শিক্ষকরা পড়াশোনা নিয়ে খুব চাপে রাখেন। আমার মেয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে। তাতেই ওর অনেক চাপ। ওদিকে টিউশনের একটা চাপ কোনো কোনো শিক্ষকের দিক থেকে তো আছেই। আর পারপিতা তো ভালো ছাত্রী।
‘হঠাৎ পরীক্ষায় খারাপ করলে তার মন খারাপ হতেই পারে। তাই বলে আত্মহত্যা করে বসবে, এটা খুব কষ্টের। এ ক্ষেত্রে মা-বাবাকেও সহনশীল হতে হবে। স্কুল এবং পরিবার যদি একসঙ্গে চাপ দেয় তাহলে মানসিক অবস্থা আরও খারাপ হয় ছেলেমেয়েদের।’
ডিআইএর তদন্ত দলকে ‘ভুল তথ্য’
ডিআইএর তদন্তের বিষয়ে জানতে চাইলে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অলিউল্লাহ্ আজমতগীর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পারপিতা ফাইহার অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় উপপরিচালক রেহানা খাতুনকে প্রধান করে দুই সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে।’
‘আপনারা আসলে কী জানতে চাইছেন?’
এমন প্রশ্নের উত্তরে আজমতগীর বলেন, ‘আত্মহত্যা বা হত্যার বিষয়ে তদন্ত করা আমাদের কাজ না। তার জন্য আলাদা কমিটি রয়েছে। এখানে পরীক্ষার খাতায় মেয়েটির কম নম্বর পাওয়াকে আত্মহত্যার কারণ হতে পারে বলে বলা হচ্ছে।
‘তাই আমরা শেষ সেমিস্টারে যারা কম নম্বর পেয়েছে, তাদের খাতা বাজেয়াপ্ত করেছি যে মার্কিংটা ঠিকভাবে হয়েছে কি না।’
পারপিতার আগের পরীক্ষার খাতাগুলো পেয়েছেন কি না জানতে চাইলে ডিআইএর কর্মকর্তা বলেন, হলিক্রস কর্তৃপক্ষ আগের খাতাগুলো দিতে পারছে না।
তিনি বলেন, ‘স্কুল কর্তৃপক্ষ আগের কোনো খাতাই দেখাতে পারেনি। তারা জানিয়েছে, পরীক্ষার পর সব খাতা শিক্ষার্থীদের বাসায় দিয়ে দেয়া হয়। স্কুলে কোনো খাতা রাখা হয় না, তবে এই খাতাগুলো পর্যবেক্ষণ করে তদন্ত কমিটি বলতে পারবে, মূল্যায়ন সঠিক কি না।’
অভিভাবকদের কাছে খাতা একেবারে দিয়ে দেয়ার বিষয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষের এ দাবি সত্য নয়। স্কুলটির সাবেক এক শিক্ষার্থী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ভালো ফলাফল করা ছাত্রীরা চাইলে বাসায় খাতা নিতে পারে, তবে সেটি আবার নিয়ে আসতে হয়। যারা খুব ভালো করতে পারেনি, তাদের খাতা অভিভাবকদের কাছে পাঠান শিক্ষকরাই। সেটি অভিভাবককে দেখিয়ে স্কুলে ফেরত দিতে হয়।
‘আর যারা একেবারে খারাপ করে, সেসব খাতা সিস্টারদের কাছে দেয়া হয়। সিস্টাররা অভিভাবকদের কল করে স্কুলে এনে কথা বলেন। তারপর সেই খাতা আবার স্কুলশিক্ষকের কাছে যায়।’
প্ররোচনা আছে কি না, দেখছে পুলিশ
তেজগাঁও থানায় গিয়ে পাওয়া যায়নি ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) অপূর্ব হাসানকে। পরে ফোনে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটি আত্মহত্যা নাকি প্ররোচনা, সে বিষয়টি তদন্তের পর জানা যাবে।’
কোনো কমিটি গঠন করা হয়েছে কি না জানতে চাইলে বলেন, ‘আমি আমার দায়িত্বের জায়গা থেকে তদন্ত করছি। আমার সঙ্গে ইনভেস্টিগেশন টিম রয়েছে।’