‘১৭ দিন ধরে কাজ বন্ধ। আন্দোলনের কারণে আমরা কাজে যাই না। কাজে না যাওয়ায় মজুরি পাই না, রেশনও পাই না। অনেক কষ্টে আছি। প্রতিদিন বাচ্চাকাচ্চারে দুইটা ভাত রান্না করে দেই, আর নিজেরা মাড় খেয়ে দিন কাটাচ্ছি।’
কথাগুলো বলছিলেন হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার বেগমখান চা বাগানের শ্রমিক মণি সাধু। বাগানে কাজ করে এতদিন তারা ৫ সদস্যের পরিবার চালিয়ে নিচ্ছিলেন।
তিনি বলেন, ‘ঘরে চাল নাই, আজ দুই টপ (ডানোর কৌটা) চাল পাইছি। রান্না কইরা বাচ্চাকাচ্চারে দিছি। ১৭ দিনের মধ্যে দুই দিন বাগান সরকারি ছুটি ছিল। এই দুই দিনের মজুরি ২২৫ টাকা আজকে পামু। এই ২২৫ টাকা দিয়ে কিতা করমু?’একই বাগানের সুমি বাগতির গল্পটাও এ রকম। ৫ বছর আগে স্বামী হারিয়ে দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে এই বাগানের আয় দিয়েই চলছেন। ১৭ দিন ধরে চা বাগানে কাজ না করায় পাচ্ছেন না চলতি সপ্তাহের মজুরি ও রেশন। ঘরে এক দিনের খাবারও নেই।
সুমি বলেন, ‘১৭ দিন ধরে যে কীভাবে আমাদের দিন যাচ্ছে সেটা কেবল আমরাই জানি। দোকান থেকে বাকিতেও জিনিস পাচ্ছি না। গ্রামের ওই মাথায় এক বাড়ি থেকে সকালে দুই মুঠো চাল ধার করে এনে রান্না করেছি। রাতে কী রান্না হবে এখন সেই চিন্তায় আছি।’
মণি সাধু আর সুমি বাগতির মতো হবিগঞ্জের বেশির ভাগের বাড়িতে এখন এই চিত্র।
আন্দোলন ও কর্মবিরতির কারণে ১৭ দিন ধরে কাজে না যাওয়ায় এই শ্রমিকদের কাছে নেই টাকা, ঘরে নেই খাবার। অনেকে জানালেন, চাল ভাজার সঙ্গে চা কিংবা শাকপাতা সেদ্ধ করে সেসব খেয়ে কাটছে দিন।
গত ৯ আগস্ট থেকে ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে দেশের অন্যান্য শ্রমিকের সঙ্গে আন্দোলনে নামেন হবিগঞ্জের ২৪ বাগানের শ্রমিকরা। দফায় দফায় বৈঠক করেও বিষয়টির সমাধান হয়নি।
সাধারণত প্রতি বৃহস্পতিবার হবিগঞ্জের চা-শ্রমিকদের সাপ্তাহিক মজুরি ও রেশন দেয়া হয়। চুনারুঘাটের চাঁন্দপুর চা বাগানের কারখানার সামনে প্রতি বৃহস্পতিবার তাই বসে হাট। নানা পদের খাবার, শিশুদের খেলনা ও নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন জিনিসের পসরা সাজিয়ে বসেন ক্রেতারা।
এবারের পরিস্থিতি দেখতে বৃহস্পতিবার সেখানে যান নিউজবাংলার প্রতিবেদক। শ্রমিকদের মজুরি হবে না বলে তেমন কোনো স্টল বসেনি সেখানে। বিকেলে শ্রমিকরা সাপ্তাহিক ও সরকারি ছুটির দুই দিনের মজুরি ও তার সমপরিমাণ রেশন পেয়েছেন।
প্রত্যেক শ্রমিককে ২৪০ টাকা করে দেয়ার কথা। কিন্তু চা-শ্রমিক ইউনিয়নের মাসিক চাঁদার ১৫ টাকা কেটে রাখেন বলে জানান শ্রমিকরা।
চাঁন্দপুর বাগানের পঞ্চায়েত প্রধান সাধন সাঁওতাল বলেন, ‘সবাই কষ্টে আছে। তবে এই কষ্টের মাঝেও শ্রমিকরা তাদের আন্দোলন চালিয়ে যেতে চায়। তাই আমরাও তাদের সঙ্গে আছি।
‘তবে নিতান্তই যারা অসহায় বা একেবারেই চলতে পারছে না, তাদেরকে পঞ্চায়েত কমিটির ফান্ড থেকে সহযোগিতা করার বিষয়ে আলোচনা চলছে।’
দৈনিক মজুরি ৩০০ টাকা করার দাবিতে গত ৯ আগস্ট থেকে আন্দোলনে নামেন দেশের ১৬৬ চা বাগানের দেড় লাখের বেশি শ্রমিক। সেদিন থেকে চার দিন পর্যন্ত ২ ঘণ্টা করে কর্মবিরতি পালন করেন।
এরপর গত ১৩ আগস্ট থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য পুরোদমে কর্মবিরতি ও বিক্ষোভ শুরু করেন তারা।