এক বছরেও খোঁজ মেলেনি চট্টগ্রামের মুরাদপুরে নালায় ডুবে নিখোঁজ হওয়া সালেহ আহমেদের। ২০২১ সালের ২৫ আগস্ট বেলা ১১টার দিকে নগরীর মুরাদপুরে পা পিছলে নালায় পড়ে নিখোঁজ হন তিনি।
ক্লোজড সার্কিট টেলিভিশন (সিসিটিভি) ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, ঘটনাটি মুরাদপুর থেকে বহাদ্দারহাটমুখী লেনে রাজা গেস্ট হাউসের সামনে ঘটেছে। রাস্তার বাম পাশে নালা, নালার পাশে দোকান। দোকানের সঙ্গে লাগায়ো এক-দেড় ফুট জায়গা, সেখান দিয়ে হাঁটতে গিয়ে নালায় পড়ে যান সবজি ব্যবসায়ী সালেহ আহমেদ। সেদিন সকাল থেকে টানা বৃষ্টিতে জলাবদ্ধ ছিল মুরাদপুর এলাকা। অন্তত ১০ ফুট গভীর সেই নালা ছিল পানিতে পূর্ণ।
পরিবারের সদস্যরা জানান, এদিন সকালে ফটিকছড়ির মাইজভান্ডার দরবার শরিফে যাওয়ার উদ্দেশে নগরীর চকবাজারের বাসা থেকে বের হয়েছিলেন তিনি। মুরাদপুর গিয়ে নালায় পড়ে যান। সেখানকার কয়েকজন তাকে উদ্ধারের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। নালায় পানির স্রোত থাকায় তিনি সঙ্গে সঙ্গে তলিয়ে যান।
সালেহ আহমেদের বাড়ি পটিয়া উপজেলার মনসা চৌমুহনী এলাকায়। নগরীর চকবাজার এলাকায় সবজির ব্যবসা করতেন তিনি।
দুই সন্তানের বাবা পঞ্চাশোর্ধ্ব সালেহ আহমেদ নালায় নিখোঁজের পর টানা পাঁচ দিন ঘটনাস্থল থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত অভিযান চালায় ফায়ার সার্ভিস। একপর্যায়ে ফায়ার সার্ভিস খোঁজা বন্ধ করে দেয়।
উদ্ধার অভিযান নিয়ে অসন্তুষ্টি
নিখোঁজের পাঁচ দিন পরও খোঁজ না মেলায় উদ্ধার অভিযান নিয়ে অসন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন সালেহ আহমেদের ছেলে সাদেকুল্লাহ মাহিন।
সে সময় নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমরা দুপুর ১২টায় খবর পেয়েছি। ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে ১টা বেজে গেছে। তখন আমি ঘটানস্থলে ফায়ার সার্ভিসকে পাইনি। তারা এসেছে ৩টা ২০ মিনিটের দিকে। ৪ ঘণ্টা দেরির কারণ জিজ্ঞেস করায় তারা বলেছে, আমার বাবার অভিভাবক না থাকায় নাকি অভিযান শুরু করতে পারেনি। একটা মানুষ পানিতে ভেসে গেছে, তাকে উদ্ধার করতে আবার অভিভাকের জন্য অপেক্ষা করতে হয় নাকি?’
সালেহ আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত
অভিযোগ অস্বীকার করে ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা বিপ্লব কুমার নাথ বলেছেন, ‘বিষয়টি আসলে এ রকম নয়। ছালেহ আহমেদ নামের ওই ভদ্রলোক নালায় পড়ে যান সকাল সাড়ে ১০টায়। এর কিছুক্ষণ পর আমরা খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যাই। তখন তীব্র স্রোত থাকায় উদ্ধারকাজ শুরু করা যায়নি। সেখানে চারদিকে পানি থাকায় সড়কে প্রচণ্ড জ্যাম ছিল। জ্যামের কারণে আমরা দুই নম্বর গেট দিয়ে ফ্লাইওভারে উঠে বহদ্দারহাট শমসেরপাড়া গিয়ে খোঁজার চেষ্টা করি। এরপর আমরা খবর পাই মুরাদপুরের পূর্ব দিকে এন মোহাম্মদ কনভেশন হলের দিকে মরদেহ পাওয়া গেছে, সেখানে গিয়ে আমরা কিছু খুঁজে পাইনি।’
ঘটনার এক বছর পরও উদ্ধার অভিযান নিয়ে অসন্তোষের কথা জানান মাহিন। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমি তখনও বলেছিলাম, উদ্ধারের চেষ্টা ভালোভাবে করা হয়নি। ওরা এক বছরেও আমার বাবাকে খুঁজে দিতে পারল না কেন?’
দোষীদের বিচার দাবি
মাহিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের জীবন থেকে বাবা অনেক কিছু নিয়ে গেছেন। বাবা না থাকলে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। মানুষজন বাবার সম্পতি নিয়ে টানাটানি করতেছে। বাবা না থাকায় কেউ গুরুত্ব দিচ্ছে না। আমি এইচএসসি শেষ করেছি, এখন কোথায় ভর্তি হব জানি না।
‘আমার ছোট বোনটা কলেজে পড়ে। আর্থিক সমস্যা প্রকট। মামারা আমাদের দেখতেছে। কিন্তু খরচের তো অভাব নেই। বাবা থাকলে এসব সমস্যা হতো না। বাবা কোনোদিন আমাদের অভাব বুঝতে দেয়নি। যাদের কারণে আজ বাবাহারা হয়েছি, তাদের বিচার চাই।’
মাহিনকে চাকরি দিয়েছিল চসিক
সে সময় দেশব্যাপী ঘটনাটি আলোচিত হলে সাদেকুল্লাহ মাহিনকে চাকরি দেয়ার ঘোষণা দেন চট্টগ্রাম সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। ১২ অক্টোবর থেকে মাহিনকে নগরীর দামপাড়ায় সিটি করপোরেশনের ফিলিং স্টেশনে চাকরি দেয়া হয়। পড়াশোনার সমস্যা ও অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারণে চাকরিটা ছেড়ে দেন মাহিন।
এরপর আর কেউ তাদের খোঁজ নেয়নি বলে জানান তিনি।
নিজের ঠিক করা কবরস্থান খালি
ব্যবসায়ী সালেহ আহমেদ নিখোঁজের এক বছর আগে বাড়ির পাশে দেয়াল দিয়ে পারিবারিক কবরস্থানের জায়গা নির্ধারণ করেছিলেন। সেই কবরস্থানে জায়গা হয়নি তার। এখনও খালি পড়ে আছে তার নির্ধারণ করা সেই কবরস্থান।
মাহিন বলেন, ‘বাবা দেয়াল দিয়ে এটা পারিবারিক কবরস্থান হিসেবে নির্ধারণ করে রেখেছিলেন। তিনি জায়গাটার খুব যত্ন করতেন। তার খুব ইচ্ছে ছিল মৃত্যুর পর সেখানে দাফন করা হবে।’
মাহিন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘১৫ আগস্ট আব্বার মাগফিরাতের জন্য দোয়ার আয়োজন করা হয়েছিল বাড়িতে। আব্বার কবরে যে একটু গিয়ে জিয়ারত করব, কবরের পাশে দাঁড়িয়ে তার জন্য দোয়া করব- সেই সুযোগ নাই। আব্বার কবরে জিয়ারত করতে চাই। আল্লাহ সেই সুযোগ দেই নাই।’
সেই নালা এখনও উন্মুক্ত
সালেহ আহমেদ নালায় পড়ে নিখোঁজ হওয়ার পর চট্টগ্রামের উন্মুক্ত নালা নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা হয় দেশজুড়ে। গত বছর ৩০ জুন চশমা খালে যাত্রীবোঝাই সিএনজিচালিত অটোরিকশা পড়ে দুজনের মৃত্যু হয়। এরপর ২৭ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ এলাকায় নালায় পড়ে মৃত্যু হয় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী শেহেরীন মাহমুদ সাদিয়ার। ৩০ নভেম্বর রাত ১০টার দিকে নগরীর কাজির দেউড়ী স্টেডিয়ামের পাশের ফুটপাত ধরে হাঁটার সময় নালায় পড়ে পা ভেঙে যায় কলেজছাত্র ইয়াসিন আরাফাতের। একই বছরের ৬ ডিসেম্বর ষোলশহর এলাকায় নালায় পড়ে এক শিশুর মৃত্যু হয়। ২০২১ সালে একে একে নালায় পড়ে প্রাণ হারান পাঁচজন। এতেও টনক নড়েনি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন কিংবা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের।
সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, বন্দরনগরীতে এখানেও ছড়িয়ে রয়েছে সাড়ে ৫ হাজারের বেশি ঝুঁকিপূর্ণ নালা ও খাল। এমনকি সালেহ আহমেদের নিখোঁজস্থলে এখন পর্যন্ত দেয়া হয়নি কোনো টেকসই নিরাপত্তা ব্যারিয়ার বা স্ল্যাব। ঘটনার পর বাঁশের অস্থায়ী বেড়া দেয় কর্তৃপক্ষ।
এই বিষয়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ‘প্রকল্পের কাজ যারা করছে, আমারা তাদের নিরপত্তাবেষ্টনী দিতে বলেছি। এটা রিভাইসের জন্য গেছে, অনুমোদন হলেই ব্যারিয়ার দিয়ে দেবে।’