চা-শ্রমিকরা ১২০ টাকার বদলে দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরির দাবি সামনে আনার পর বাগান মালিকরা সব সুযোগ-সুবিধা মিলিয়ে মজুরি আসলে ৪০২ টাকা বলে যে দাবি করছেন, সেটি সঠিক কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
যারা চা-শ্রমিকদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, তারা বলছেন, যেসব ভাতার কথা বলে বাগান মালিকরা বেশি মজুরির দেয়ার দাবি করছেন, আইনত সেগুলো মজুরির অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না।
এটি সত্য, মজুরির বাইরেও চা-শ্রমিকরা আবাসন, রেশন, সন্তানের শিক্ষা, চিকিৎসা ভাতা পান। আছে বিনোদন ভাতা, উৎসব ভাতাও। আর এসব সুযোগ-সুবিধা মিলিয়েই প্রতিদিন প্রতি জনের পেছনে ন্যূনতম ৪০২ টাকা ব্যয় হয় বলে দাবি বাগান মালিকদের।
দৈনিক মজুরি ৩০০ টাকা করার দাবিতে সিলেট অঞ্চলের ১৬৬টি চা-বাগানের দেড় লাখের বেশি শ্রমিক যখন আন্দোলনে, তখন বাগান মালিকদের সংগঠনের পক্ষ থেকে এই প্রচার চালানো হচ্ছে।
বাগান মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ চা সংসদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, মজুরি হিসেবে নগদ অর্থ ছাড়াও একজন শ্রমিককে দৈনিক ঘর ভাড়া বাবদ ৭৬.৯২ টাকা, চিকিৎসা বাবদ ৭.৫০ টাকা, ভূমি উন্নয়ন কর বাবদ ০.০২টাকা, বাসাবাড়িতে উৎপাদিত ফলমূল বাবদ ১৪ টাকা, অবসরভাতা ২ টাকা, গরু চরানো বাবদ ১ টাকা, চা শ্রমিক পোষ্যদের শিক্ষা ব্যয় বাবদ ১.৫০ টাকা দেয়া হয়।
দৈনিক মজুরি বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করার দাবিতে শনিবার সকাল থেকে একযোগে সীমিত কর্মবিরতি পালনের পর অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটের ডাক দেয় বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়ন। ফাইল ছবি
তবে মালিকরা যে এসব সুযোগ-সুবিধাকে মজুরি দাবি করছেন, তা বাংলাদেশ শ্রম আইনের ২ ধারার ৪৫ উপধারা অনুযায়ী করা যায় না।
মজুরির সংজ্ঞায় বলা হয়েছে: ‘মজুরি’ অর্থ টাকায় প্রকাশ করা হয় বা যায় এমন সব পারিশ্রমিক যা চাকরির শর্তাবলী, প্রকাশ্য বা উহ্য যেভাবেই থাকুক না কেন পালন করা হলে কোনো শ্রমিককে তার চাকরির জন্য বা কাজ করার জন্য দেয়া হয়। এবং এমন প্রকৃতির অন্য কোনো অতিরিক্ত প্রদেয় পারিশ্রমিকও এর অন্তর্ভুক্ত হবে, তবে নিম্নলিখিত অর্থ তার অন্তর্ভুক্ত হবে না। যেমন:
(ক) বাসস্থান সংস্থান, আলো, পানি, চিকিৎসা সুবিধা বা অন্য কোনো সুবিধা প্রদানের মূল্য অথবা সরকার কর্তৃক সাধারণ বা বিশেষ আদেশ দ্বারা বাদ দেয়া হয়েছে এমন কোনো সেবার মূল্য
(খ) অবসর ভাতা তহবিল বা ভবিষ্যৎ তহবিলে মালিক কর্তৃক প্রদত্ত কোনো চাঁদা
(গ) কোনো ভ্রমণ ভাতা অথবা কোনো ভ্রমণ রেয়াতের মূল্য
(ঘ) কাজের প্রকৃতির কারণে কোনো বিশেষ খরচ বহন কবার জন্য কোনো শ্রমিককে প্রদত্ত অর্থ
আইনের এই ধারার কথা তুলে ধরে চা-বাগান শিক্ষা অধিকার বাস্তবায়ন পরিষদের সংগঠক সঞ্জয় দাস বলেন, ‘বাগান মালিকরা মিথ্যাচার করছেন, অপপ্রচার চালাচ্ছেন। শ্রম আইন ও বাস্তবতার সঙ্গে তাদের প্রচারণার কোনো মিল নেই।’
মঙ্গলবার চা সংসদের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়- চা-শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের পরোক্ষ যেসব সুবিধা প্রদান করা হয়ে থাকে তা বাংলাদেশের অন্যান্য শিল্পের তুলনায় নজিরবিহীন।
এই শিল্পে প্রতি শ্রমিককে ২ টাকা কেজি দরে মাসে প্রায় ৪২ কেজি চাল বা আটা রেশন হিসেবে দেয়া হয়। যার বাজার মূল্য প্রায় ২ হাজার ৩১০ টাকা। তাছাড়া শ্রমিকদের খাদ্য নিরাপত্তা আরো সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে চা-শিল্পে প্রায় ৯৪ হাজার ২০০ বিঘা জমি চাষাবাদের জন্য বিনা মূল্যে চা-শ্রমিকদের মধ্যে বণ্টন করা হয়েছে।
তবে বাগান মালিকদের এমন প্রচারকেও মিথ্যাচার বলছেন সিলেটের মালনীছড়া চা-বাগানের শ্রমিক রিতেশ মোদী।
সব সুযোগ-সুবিধা মিলিয়ে একজন চা-শ্রমিকের পেছনে দৈনিক ন্যূনতম ৪০২ টাকা ব্যয় হয় বলে দাবি বাগান মালিকদের। ছবি: নিউজবাংলা
তিনি বলেন, ‘মালিকপক্ষের দাবির তুলনায় রেশন অনেক কম এবং নিম্নমানের। একজন পুরুষ শ্রমিকের স্ত্রী ও সন্তান রেশন পেলেও নারীরা পোষ্যের জন্য রেশন পান না। এ ছাড়া কোনো কারণে কাজে অনুপস্থিত থাকলে রেশন কাটা হয়।’
সংবাদ সম্মেলনে বাগান উদ্যোক্তাদের দাবি, চা উত্তোলনের কোনো নির্দিষ্ট সীমা নেই, সে ক্ষেত্রে একজন শ্রমিক দৈনিক কর্মঘণ্টার মধ্যে অতিরিক্ত পাতা উত্তোলনের জন্য বোনাস পেয়ে থাকেন, যা বাগানভেদে গড়ে দৈনিক ৬৫ টাকা হয়।
রোববার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে কাজ করে আরও অতিরিক্ত আয় করে থাকেন উল্লেখ করে দাবি করা হয়, এ ক্ষেত্রে একজন শ্রমিক দৈনিক গড়ে প্রায় ১৮০ থেকে ১৮৫ টাকা পর্যন্ত নগদ মজুরি পেয়ে থাকেন।
তা ছাড়া বার্ষিক ছুটি ভাতা, বেতনসহ ১৪ দিনের উৎসব ছুটি ভাতা, ২০ দিনের অসুস্থজনিত ছুটি ভাতা, ভবিষ্যৎ তহবিল ভাতা, কাজে উপস্থিতি ভাতাসহ আরও কিছু প্রত্যক্ষ সুবিধা মিলিয়ে একজন শ্রমিক দৈনিক গড়ে ২৪৬ টাকা নগদে পেয়ে থাকেন বলেও দাবি করেন তারা।
তবে ছুটির দিনে কাজ করালে অতিরিক্ত অর্থ দিতে হবে সেটি শ্রম আইনের একটি সাধারণ বিষয়।
শ্রম আইনের ১০৮(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো শ্রমিক কোনো প্রতিষ্ঠানে কোনো দিন বা সপ্তাহে এই আইনের অধীন নির্দিষ্ট সময়ের অতিরিক্ত সময় কাজ করেন, সে ক্ষেত্রে তিনি সেই কাজের জন্য তার মূল মজুরি ও মহার্ঘ ভাতা এবং এডহক বা অন্তর্বর্তী মজুরি, যদি থাকে, এর সাধারণ হারের দ্বিগুণ হারে ভাতা পাবেন।’
ফলে ছুটির দিনে কাজ করাকে মজুরি হিসেবে দেখানো যাবে না।
লাক্তাতুরা চা-বাগানের শ্রমিক মতিলাল হাজরা বলেন, অনেক শ্রমিক দিনে ১২০ টাকাও আয় করতে পারেন না। কারণ এই পরিমাণ টাকা আয়ের জন্য একজন শ্রমিককে ২৩ কেজি পাতা তুলতে হয়, যেটা অনেক সময় সম্ভব হয় না। নারী ও বয়স্ক শ্রমিকরা এই পাতাও অনেকদিন তুলতে পারেন না।
কিছু শ্রমিক ওভারটাইম করে বাড়তি আয় করেন। তবে বেশির ভাগের পক্ষেই তা সম্ভব হয় না বলেও ভাষ্য তার।
শ্রম আইনের সঙ্গে নিজেদের দাবির ফারাক সম্পর্কে চা-শিল্পের উদ্যোক্তা ও সিলেট মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আফজাল রশীদ চৌধুরী বলেন, ‘আমরা যে সেবাগুলো দিচ্ছি, তা মজুরি হিসেবে ধরা যাবে না। কিন্তু আমাদের তো এই টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। ব্যবসা করেই আমাদের এই টাকা দিতে হয়। ব্যবসায় যদি লাভই না করতে পারি তবে এসব সেবা কোত্থেকে দেব?’
বাগান মালিকদের এমন দাবি প্রসঙ্গে সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এমাদউল্লাহ শহিদুল ইসলাম শাহিন বলেন, ‘তাদের এইা দাবি সম্পূর্ণ প্রতারণামূলক। বাগান ইজারা নেয়ার শর্তেই আছে, শ্রমিকদের বাসস্থান করে দিতে হবে। চা চাষের বাইরের জমি শ্রমিকদের চাষবাষের জন্য দিতে হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় বাগান মালিকরা রাবার বাগান করে, মাচ চাষ করে সব জমি নিজেরাই দখল করে নেন। শ্রমিকদের চাষের জন্য কোনো জায়গা ফাঁকা থাকে না।’
তিনি বলেন, ‘শ্রমিকদের আবাসন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের জন্য যে সেবা দেয়া হয় তা খুবই নাজুক। বেশির ভাগ বাগানেই স্কুল নেই। চিকিৎসক নেই, ওষুধ নেই। ফলে বাগান মালিকদের এসব প্রচারণার কোনো ভিত্তি নেই। নিজেদের শোষণ টিকিয়ে রাখকেই তারা এই অপপ্রচার চালাচ্ছেন।’