২৫ আগস্ট মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ৫ বছর পূর্ণ হচ্ছে। কিন্তু দিন দিন অবনতির দিকেই যাচ্ছে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩৪ রোহিঙ্গা শিবিরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি।
ইয়াবা পাচার, ডাকাতি, চুরি, হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধে গত ৫ বছরে ২ হাজার ৪৩৮টি মামলায় আসামি হয়েছেন ৫ হাজার ২২৬ জন রোহিঙ্গা। আর খুন হয়েছেন ১১৫ জন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর তথ্য মতে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের নামে অস্ত্র মামলা হয়েছে ১৮৫টি, মাদক ১৬৩৬টি, ধর্ষণ ৮৮টি, হত্যা ১০০টি এবং অপহরণ-মুক্তিপণ আদায়ের মামলা হয়েছে ৪৯টি।
আরেকটি পরিসংখ্যান বলছে, রোহিঙ্গাদের শুরুর তিন বছরে অর্থাৎ ২০২০ সালের ২৫ আগস্ট পর্যন্ত কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিরুদ্ধে ১২ ধরনের অপরাধে কমবেশি ৭৩১টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামি হয়েছেন ১ হাজার ৬৭১ জন রোহিঙ্গা।
এর মধ্যে শুরুর বছর ২০১৭ সালে মামলা হয়েছিল ৭৬টি, আর আসামি হন ১৫৯ জন। পরের বছর ২০১৮ সালে ২০৮ মামলায় আসামি হন ৪১৪ রোহিঙ্গা। ২০১৯ সালে মামলার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২৬৩টি আর আসামি হন ৬৪৯ জন।
পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে, মানবিক বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মাঝে প্রতি বছরই অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে। শুধু ইয়াবা নয়, ভয়ংকর মাদক ক্রিস্টাল মেথ বা আইস পাচারেও জড়িয়ে পড়েছে তারা। এ ছাড়াও আধিপত্য বিস্তার নিয়েও হত্যা, গুম, অপহরণ করে চাঁদা দাবিসহ নানা অভিযোগে তারা অভিযুক্ত।
স্থানীয়দেরও অভিযোগ, রোহিঙ্গারা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। ক্যাম্পে কয়েকটি গ্রুপ মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িত। তারা মিয়ানমার থেকে সরাসরি ইয়াবার চালান এনে ক্যাম্পে মজুত রাখে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কড়াকড়ির মধ্যেও তারা ক্যাম্পে ইয়াবার চালান, মজুত ও লেনদেন করছে।
দায়িত্বশীল কয়েক কর্মকর্তা জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিঞ্জি হওয়ায় সেখানে যখন-তখন অভিযান চালানো সম্ভব হয় না আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর পক্ষে। অপরাধীরা তাই সেখানে অবস্থান করে গা ঢাকা দেয়াসহ নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িত হচ্ছে। আর অধিকাংশ ক্যাম্প পাহাড়সংলগ্ন হওয়ায় কয়েকটি ডাকাতদলের তৎপরতাও বেড়েছে।
উখিয়ার হলদিয়াপালং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইমরুল কায়েস চৌধুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। বিপুল এই জনগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করা অনেক কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তাদের নানা কর্মকাণ্ড আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাকেও ভাবিয়ে তুলেছে।’
কক্সবাজার পিপলস ফোরামের মুখপাত্র এইচ এম নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বেপরোয়া হওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন অপরাধে জড়াচ্ছে রোহিঙ্গারা। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, তারা বেশির ভাগ সময় স্থানীয়দের ওপর আগ্রাসী মনোভব দেখাচ্ছে।’
৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. কামরান হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সব ক্যাম্পেই এপিবিএনের তৎপরতা রয়েছে। ক্যাম্পের অপহরণ বাণিজ্য, মাদক চোরাচালানসহ নানা অপরাধ ঠেকাতে আমরা নিয়মিত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
রোহিঙ্গাদের অপরাধ নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে জেলা পুলিশের পাশাপাশি ক্যাম্পে এপিবিএনের তিনটি ব্যাটালিয়ন কাজ করছে। পাশাপাশি র্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশও সেখানে আছে।’
জানতে চাইলে র্যাব-১৫-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. খায়রুল ইসলাম সরকার নিউজবাংলাকে দাবি করেছেন, বেশির ভাগ রোহিঙ্গাই সীমান্তে মাদক চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত। নিয়মিত অভিযানে গ্রেপ্তার একাধিক রোহিঙ্গা এমন তথ্য দিয়েছেন।
অস্ত্র-ইয়াবাসহ নানা অপরাধে জড়িত রোহিঙ্গাদের ওপর নজরদারি বাড়িয়ে অভিযান আরও জোরদার করা হবে বলেও জানান এই র্যাব কর্মকর্তা।
যেভাবে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে
আশির দশকে নাগরিকত্ব আইন প্রণয়ন করে মিয়ানমারের জান্তা সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার কেড়ে নেয়। ২০১৬ সালের অক্টোবরের শুরুর দিকে ধাপে ধাপে সামরিক প্রচারণা চালিয়ে সেখানকার বাসিন্দাদের রোহিঙ্গা বিদ্বেষী করে তোলা হয়। পরে ৯ অক্টোবর রোহিঙ্গাদের ওপর সেনা ও স্থানীয় মগদের নির্যাতন শুরু হয়।
ওই দিন থেকে কয়েক দফায় বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা প্রবেশ করেছে। এর আগেও ১৯৭৮ ও ১৯৯২ সালে অসংখ্য রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। ১৯৭৮ ও ১৯৯২ সালে যারা বাংলাদেশে আসে তাদের কুতুপালং ও টেকনাফের নয়াপাড়ায় দুটি ক্যাম্প রাখা হয়।
কিন্তু ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট আবারও নিপীড়নের মুখে বাংলাদেশে আসতে শুরু করে রোহিঙ্গারা। এ সময় ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। নতুন পুরাতন মিলিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছে।