চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত বিভিন্ন দলের নেতাদের বক্তব্যে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছিল। কিন্তু আগস্টে সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে এসেছে।
বিএনপি নেতাদের আন্দোলনের হুমকি, মানবাধিকার ইস্যুতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অভিযোগ জানানোর পর সরকারের দিক থেকে কঠোর মনোভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে বলে মনে করছেন রাজনীতিবিদরা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোববার এক আলোচনা সভায় বলেন, ‘খুনিদের নির্বাচনে আনতে হবে, এমন আহ্লাদ কেন?’ তার এ বক্তব্যের পর আলোচনা বা সংলাপের সম্ভাবনা আপাতত নেই বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকরা।
আওয়ামী লীগ নেতারাও বলছেন, এ দেশে আর কখনও তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসবে না। আদালতের রায়ে এ ব্যবস্থা বাতিল হয়ে গেছে। আগামী নির্বাচন হবে সংবিধান অনুযায়ী। আওয়ামী লীগ কোনোভাবেই সংবিধানের বাইরে যাবে না।
আওয়ামী লীগের ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের জনসভায় গ্রেনেড হামলার দেড় যুগ পূর্তির দিন রোববার সকালে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে দলীয় কার্যালয়ের সামনে আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছবি: সংগৃহীত
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিএনপি আলোচনা করতে চাইলে সরকারকে অনুরোধ করতে পারে। তবে সেটাও হতে হবে বিনা শর্তে। তাহলে ভেবে দেখা যেতে পারে। তবে বিএনপির সঙ্গে আলোচনার কোনো সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি। আর তাদের যে মূল দুই দাবি– নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার এবং খালেদা জিয়ার স্থায়ী মুক্তি, সেগুলোতে সরকারের কিছু করার নেই। কেননা আওয়ামী লীগ সংবিধানসম্মতভাবে নির্বাচন চায়। আদালতের রায়ে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকার তথা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়ে গেছে। তাই এ বিষয়ে আলোচনা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’
খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি আদালতের বিষয় উল্লেখ করে হানিফ বলেন, আইনি প্রক্রিয়াতেই তাদের এ সমস্যার সমাধান করতে হবে।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি বছর খানেকের বেশি। কিন্তু দিন যত ঘনিয়ে আসছে, সরকার ও বিরোধী দলগুলোর বিপরীত ও দ্বন্দ্বমূলক রাজনীতির উত্তাপ বেড়েই চলছে। সরগরম হয়ে উঠছে রাজপথ। বিএনপি ও এর শরিকরা বছরজুড়েই মিছিল-সভা-সমাবেশ-বিক্ষোভে ব্যস্ত ছিল।
এসব কর্মসূচিতে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন, দলটির প্রধান খালেদা জিয়ার স্থায়ী মুক্তিসহ নির্বাচন নিয়ে একাধিক দাবি তুলে ধরে দলটি। সরকারের পক্ষ থেকেও গত জুলাই পর্যন্ত নমনীয় ভাব লক্ষ করা যাচ্ছিল।
আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এবং শীর্ষপর্যায়ের নেতারা বলে আসছিলেন, তারা চান বিএনপি নির্বাচনে আসুক। সরকার সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন চায় বলে তারা বক্তব্য রাখছিলেন। দলটির গত ৭ মের কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করতে বিএনপির অংশগ্রহণের ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। ওই সভায় বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে সরকারকেই উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দেন আওয়ামী লীগের একাধিক শীর্ষ নেতা। পরদিন দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সংবাদ সম্মেলনেও উল্লেখ করেন, তারা চান বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিক।
বিএনপির সঙ্গে আলোচনা বা সংলাপের কোনো সম্ভাবনা আছে কি না জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কী জন্য সংলাপ, কীসের দাবিতে সংলাপ? তাদের দাবীকৃত নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকারের অস্তিত্ব এ দেশের সংবিধানে নেই। আর সরকার সংবিধানসম্মতভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানে বদ্ধপরিকর। এখানে আলোচনার কিছু নেই।’
নির্বাচনে অংশগ্রহণ যেকোনো রাজনৈতিক দলের সাংবিধানিক অধিকার উল্লেখ করে মতিয়া চৌধুরী বলেন, ‘গণতন্ত্রের স্বার্থে, এ দেশের স্বার্থে বিএনপির নির্বাচনে আসা উচিত। আমরা চাই সব দল নির্বাচনে অংশ নিক।’
গত মে মাসে আওয়ামী লীগের ওই বৈঠকের পর মনে করা হচ্ছিল, প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে। কিন্তু চলতি মাসে এসে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। বিএনপি নেতাদের ‘সরকার পালাবার পথ পাবে না, অচিরেই পদত্যাগ করতে হবে, খেলা হবে’সহ বিভিন্ন বক্তব্য দিতে দেখা যায়।
শাসক দল আওয়ামী লীগের নেতারাও বলতে শুরু করেন, ‘শোকের মাস আগস্ট পার হতে দেন, তারপর টের পাবেন, আগস্ট পার হলেই রাজপথ দখল করা হবে।'
এরই মধ্যে গত ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলার ঘটনার বার্ষিকী স্মরণ করে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ করে আওয়ামী লীগ। বলা যায়, রাজপথে সাড়ম্বরে উপস্থিতি জানান দেয় দলটি।
গত সপ্তাহে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক প্রধান মিশেল ব্যাচেলেট সফরে এলে তার কাছে সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন, গুম-খুনসহ বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ধরে বিএনপি। ক্ষমতাসীনরাও সমানতালে জবাব দিতে শুরু করেন।
২০১২ সাল থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করে সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠন করেন রাষ্ট্রপতি। ফাইল ছবি
সর্বশেষ গত রোববার এক বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘যারা ১৫ আগস্টের পক্ষে ছিল, যারা ২১শে আগস্টের ঘটনায় মদদ দিয়েছে, হত্যা, খুন করাই তো ওদের চরিত্র। তাদের সঙ্গে বসতে হবে? তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে? তাদের খাতির করতে হবে? তাদের ইলেকশনে আনতে হবে? এত আহ্লাদ কেন, আমি তো বুঝি না। বাংলাদেশে কি মানুষ নাই!’
তার এমন বক্তব্যের পর মনে করা হচ্ছে ক্ষমতাসীন দল আর আলোচনায় আগ্রহী নয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক হারুনুর রশীদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিএনপির দাবি তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকার। কিন্তু এই কনসেপ্ট তারা নিজেরাই নষ্ট করেছে নির্দিষ্ট একজন বিচারপতিকে প্রধান বানানোর জন্য বিচারপতিদের বয়স বাড়িয়ে। আবার আদালতে যাওয়ার পর এ ব্যবস্থাই বাতিল হয়েছে। আর তা ছাড়া মূল কথা হলো, এটা শুধু বিএনপির দাবি, এ ইস্যুতে তারা জনগণকে সম্পৃক্ত করতে পারেনি বা সমর্থনও পায়নি।’
তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার গত রোববারের বক্তব্যে বিএনপির এ দাবি মানা হবে না সেটাই স্পষ্ট করেছেন। সরকার সাংবিধানিক পদ্ধতিতেই নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর এবং এ ইস্যুতে কোনো সংলাপ বা আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতার কিছু নেই, সেটাই বলেছেন তিনি।’
তবে রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই মন্তব্য করে অধ্যাপক হারুন বলেন, ‘অন্যান্য ইস্যু নিয়ে আলোচনা হওয়ার সুযোগ এখনও আছে।’