বাস র্যাপিড ট্রানজিট বা বিআরটি প্রকল্পের বক্স গার্ডার দুর্ঘটনায় রাজধানীর উত্তরায় পাঁচজনের মৃত্যুর চার দিন পর নিরাপত্তা-বেষ্টনী বসিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। তবে যে বেষ্টনী বসানো হচ্ছে সেটি পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন ওই সড়ক দিয়ে চলাচলকারী পথচারীরা।
কেবল পথচারীরা নন, বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক হাদিউজ্জামানও সব শুনে বলেছেন, এভাবে নিরাপত্তা-বেষ্টনী দেয়া হলে সেটি আন্তর্জাতিক মানের হবে না।
বাদল হোসেন নামে এক পথচারী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নিরাপত্তা-বেষ্টনী তৈরি হচ্ছে ঠিকই, তবে এটি যেখানে কাজ চলছে তার খুব কাছাকাছি। এতে নিরাপত্তা কতটুকু নিশ্চিত হবে তা স্পষ্ট নয়। বেষ্টনী আরেকটু দূরে দেয়া যেত। তবে সে ক্ষেত্রে রাস্তা সংকীর্ণ হয়ে যাবে। চলাচলে জনগণের ভোগান্তি বাড়বে। সে ক্ষেত্রে এখানে ট্রাফিক পুলিশ থাকতে হবে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে। অথচ এখানে কোনো ট্রাফিক পুলিশ নেই।’
সমস্যা হলেও নিরাপত্তায় আরও জোর দেয়ার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কিছুটা ভোগান্তি সহ্য করা যায়। কিন্তু দুর্ঘটনা থেকে সুরক্ষা জরুরি।’
আরেক পথচারী মালেক মিয়া বলেন, ‘এই বেষ্টনী যেভাবে করা হচ্ছে তাতে দুর্ঘটনা এড়ানো যাবে কি না তা প্রশ্নসাপেক্ষ। কারণ, এটা মজবুত নয়। ক্রেন থেকে আবার কিছু পড়ে গেলে দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হবে না। তাই আমরা পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারছি না।’
গত ১৫ আগস্ট নিরাপত্তা-বেষ্টনী তৈরি না করে ক্রেন দিয়ে বক্স গার্ডার তুলে একটি গাড়িতে রাখার সময় সেটি পড়ে যায় একটি চলন্ত গাড়ির ওপর। এতে ওই গাড়ির পাঁচ আরোহী নিহত হন। গুরুতর আহত হন দুজন।
এই প্রাণঘাতী দুর্ঘটনার পর গোটা প্রকল্পের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়। এরপর করপোরেশনের সঙ্গে বিআরটি প্রকল্পের আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয় পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেই কাজ চলবে।
সোমবার কাজ শুরুর পর দুর্ঘটনাস্থল জসিম উদ্দীন মোড়ে গিয়ে দেখা যায়, জনা চারেক কর্মী কাজ করছেন। তারা চার মিলিমিটার পেরেক, টিন আর অ্যাঙ্গেল দিয়ে তৈরি করছিলেন নিরাপত্তা-বেষ্টনী।
নিরাপত্তা কর্মী বিদ্যুৎ কুমার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এখানে দায়িত্বরত প্রকৌশলীদের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা কাজ করছি। নিরাপত্তা-বেষ্টনীর কাজ শেষ করার পরই প্রকল্পের কাজ শুরু হবে।’
সেখানকার কর্মীদের বক্তব্য এবং নিরাপত্তা-বেষ্টনী নিয়ে পথচারীদের সংশয়ের বিষয়ে কথা বলতে প্রায় দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর পাওয়া গেল একজন প্রকৌশলীকে। কর্মচারীদের মাধ্যমে জানা গেল তার নাম জহির। তবে প্রশ্ন শুনে সেই কর্মকর্তা নিজের পরিচয় লুকিয়ে বলেন, ‘আমি এখানকার কেউ না। আমি দেখতে এসেছি।’
এরপর হনহন করে হেঁটে চলে যান তিনি।
আরেক প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেনের কাছ থেকেও প্রশ্নের কাঙ্ক্ষিত জবাব পাওয়া যায়নি। তিনি বলেন, ‘আমরা নিরাপত্তা-বেষ্টনীর কাজ শুরু করেছি। দ্রুতই শেষ হয়ে যাবে আশা করছি। বেষ্টনীর কাজ শেষ না হলে আমরা ফ্লাইওভারের কাজ শুরু করব না।’
নিরাপত্তা-বেষ্টনী সম্পর্কে এসব তথ্য জানানোর পর বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক হাদিউজ্জামান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার মনে হয় না টিন দিয়ে ঘেরাও দেয়া কোনো বেষ্টনী নিরাপত্তার স্ট্যান্ডার্ডের মধ্যে পড়ে। সেটাকে অবশ্যই মজবুত হতে হয়, যেন যানবাহনের ক্ষতি এবং জনসাধারণের জীবন হুমকির মধ্যে না পড়ে।'
তিনি বলেন, ‘আমাদের সামনে অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। মেট্রোরেলের ব্যারিকেড ব্যবস্থাপনা ও থার্ড টার্মিনালের ব্যবস্থাপনা এক্ষেত্রে উদাহরণ হতে পারে। তারা একটা ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড মেনে কাজ করছে। এ ক্ষেত্রেও তাদেরকে (বিআরটি) অবশ্যই ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড মেনে চলতে হবে। এর বিকল্প নেই।’
পর্যাপ্ত লোকবল ছাড়া চলছে প্রকল্পের কাজ
সেখানে কাজ করা একজন কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে জানান, যতসংখ্যক লোক দিয়ে কাজ করানো উচিত, তাদেরকে কর্মী দেয়া হয়েছে তার চেয়ে অনেক কম। এ কারণেই তিন বছরে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ১০ বছরেও শেষ হয়নি প্রকল্প।
কারণ হিসেবে তিনি বলেন ‘যেখানে এই কাজের জন্য ২ হাজারের বেশি শ্রমিক প্রয়োজন, সেখানে কাজ করছে ৩০০ জন। এয়ারপোর্ট থেকে গাজীপুর পর্যন্ত ১৯ কিলোমিটার ফ্লাইওভারের প্রজেক্টে প্রতি কিলোমিটারে ১৯টি সেন্টারে ভাগ করে কাজ চলছে।এখানে প্রতিটি সেন্টারে কমপক্ষে ৮০ থেকে ১০০ জন দরকার। অথচ কাজ করছে ১০ জন। প্রয়োজনীয়সংখ্যক লোক থাকলে কাজ শেষ করতে এত সময় লাগত না। জনগণের ভোগান্তিও বাড়ত না।’
তিনি আরও বলেন, ‘চীনা যে কোম্পানির (সিজিজিসি) আওতায় কাজ চলছে, তাদের ঢাকায় কর্মরত কর্মকর্তা ১৫ আগস্ট ওই দুর্ঘটনার সময় এখানে উপস্থিত ছিলেন। এরপর থেকে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। তবে দুর্ঘটনার আগে তিনি সরাসরি স্পটে এসে আমাদেরকে নির্দেশনা দিতেন।’
এভাবে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শুরুতে নিরাপত্তা-বেষ্টনী ছিল। পরে সেটি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় নতুন করে আর করা হয়নি। প্রায় এক বছর ধরে এভাবে বেষ্টনী ছাড়াই কাজ চলেছে।’
গাজীপুর থেকে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত বিরতিহীন বাস সার্ভিস চালু করতে এই বিআরটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়।
২০১২ সালে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। শেষ করার কথা ছিল ২০১৭ সালে। তবে নানা জটিলতায় বার বার পিছিয়েছে কাজ। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত কাজ শেষ হয়েছে ৬৮ শতাংশ। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে এই কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
বিআরটি প্রকল্পটি চীনের জিয়াংশু প্রভিন্সিয়াল ট্রান্সপোর্টেশন ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড ও গেজুবা গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড বাস্তবায়ন করছে।